ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীনঃ দেখতে যে পাবো না এটা জেনেও আকাশ পানে তাকিয়ে বাবাকে খুঁজি। লক্ষকোটি তাঁরার মাঝে আব্বাকে খোঁজার একটা মজাও আছে। গায়ে শিহরণ জাগানো মজা। তাঁরার মেলায় হঠাৎ কখনো চলমান তাঁরাও চোখে পড়ে। অবাক বিস্ময়ে ভাবি, ওই চলমান তাঁরাটিই কি আব্বা! জানি ওটা রকেট কিংবা কোন স্যাটেলাইট। তারপরও এমনই মনে হয়। মনে হয়, আব্বা নিজেও এই খোঁজার কাজে আমার সাথেই আছেন। তাঁরাদের ভীড়ে আমার সাথে লুকোচুরি খেলছেন। শোনিম যেমন আমার সাথে খেলে।
শোনিমের দাদাভাই আগাগোড়াই একজন খাঁটি শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। শুধু তিনি নন; তাঁর বাবাও ছিলেন। বাপবেটা দু’জনেই ব্রিটিশ আমলের মেট্রিকুলেট। ঐ আমলে দশগ্রাম খুঁজেও একজন মেট্রিকুলেট মিলতো না। তিনি খুবই প্রতিভাবান ছিলেন। যেমনি ছিল তাঁর কলমের জোর, তেমনি ছিল তাঁর বাগ্মিতা। পুরো ইংরেজী ডিকশনারী তাঁর আত্মস্থ ছিল। ইংরেজীতে এমন কোন শব্দ নেই যা তাঁর জানা ছিল না। ইংরেজী গ্রামারে তাঁর প্রজ্ঞা গর্ব করে বলার মত।
তাঁর জীবদ্দশায় আমরা পারতপক্ষে জোরে জোরে ইংরেজী পড়তাম না বা বলতাম না। আশেপাশে চোখকান খোলা রেখে জানার চেষ্টা করতাম ধারেকাছে আব্বা আছেন কিনা। না থাকলে যেমন তেমন। থাকলে মহা বিপদ হতো। যত ব্যস্তই থাকতেন কান সজাগ রাখতেন আমাদের পড়ার দিকে। আমাদের বলায় ভুল হলে থামিয়ে দিতেন; শুধরে দিতেন। আব্বার কাছে শুনেছি তিনি ইংরেজী শিখেছেন আমার দাদাজানের কাছে। তিনি নাকি এ বিষয়ে পন্ডিততুল্য ছিলেন।
মানুষ হিসেবেও তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। অনেক আগের কথা। ঘরে ঘরে তখন ল্যান্ড ফোনও ছিল না। একটি ফোন করার জন্যে মানুষকে অনেক কষ্ট করতে হতো। আমাদের বাসার ফোনটি ছাড়া আশেপাশে আর কারো বাসায় ফোন ছিল না। দেখা যেত দিনে নিজেদের ফোন যদি আসতো পাঁচটি, অন্যের ফোন আসতো দশটি। আমরা কেউ বাসায় না থাকলে ফোন ধরতেন আব্বা। সে কী নরম সুরে আব্বার কথা বলা! অপর প্রান্তের মানুষকে বিনয়ের সাথে অপেক্ষায় থাকতে বলে নিজেই বের হয়ে যেতেন পাশের বাসার মানুষকে ডেকে আনতে। অথচ তাঁর শরীরের অবস্থা তখন ততটা ভাল ছিল না। হার্টের সমস্যা এবং ডায়বেটিসে তিনি খুবই দূর্বল।
খুব দূর্বল তিনি ছিলেন সন্তানদের প্রতিও। ধলা স্কুলের চরম অব্যবস্থাপনায় আমাকে নিয়ে মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। আমি এসএসসি ক্যান্ডিডেট; সামনেই পরীক্ষা। অথচ স্কুলে কোন ক্লাশ হয় না। শিক্ষকদের স্ট্রাইক। তিনমাসেও স্ট্রাইক শেষ হচ্ছে না। অথচ আমার পড়াশুনা বাড়ানো দরকার। ক্লাশের উপর ভরসা করে বসে থাকার সময় নেই। এসএসসি’র মহা প্রস্তুতি নিতে হবে। পাশাপাশি, থাকার জায়গাটা নিয়েও ভাবতে হবে।
সদা মহাব্যস্ত প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর ধলা বাজারের ঠিক মাঝখানের ব্যস্ত মহাজনী ঘরে থেকে আর যাই হোক এসএসসি’র প্রস্তুতি হয় না। কথাটি আমার নয়; মোজাম্মেল স্যারের। আব্বা ঢাকা থেকে ধলা এসেছেন স্যারের সাথে কথা ফাইনাল করে আমার প্রাইভেট টিউটর হিসেবে নিয়োগ দিয়ে যাবেন। বাংলা, ইংরেজী এবং ইসলামিয়াত ছাড়া বাকী সব সাবজেক্ট স্যার দেখভাল করবেন। স্যারের পরামর্শে আব্বা আমার জন্যে নতুন বাসা দেখলেন। শচীন্দ্র কাকার বাসার অর্ধেকটা আমার জন্যে ঠিক করে কথা পাকাপাকিও করলেন।
আমিও মোটামুটি গোছগাছ করে বাসায় উঠে পড়লাম। শচীন্দ্র কাকার বড় ছেলে শংকর আমার দু’বছরের জুনিয়র। ওরা দুইভাই। মাসীমা, মানে ওর মা দারুণ মমতাময়ী। খুব আদর করতেন আমায়। মোটামুটি সুখের সংসার তাঁর। কিন্তু একটা কষ্ট ছিল। ঘুম ছিল না তাঁর চোখে। দিনে কিংবা রাতে তিনি কখনোই ঘুমুতেন না। ঘুমুতে পারতেন না। বছরের পর বছর না ঘুমিয়ে কাটাতেন। ঘরের মাঝ বরাবর থাকা বেড়ার একপাশে আমি, আর অন্যপাশে মাসীমা। রাতে আমার পড়া কিছুক্ষণ থেমে থাকলেই মাসীমা ডাকতেন; শাহীন, শাহীন! বাবা, ঘুমাইছো! ঘুমায় না, বাবা! উইঠঠা পড়ো। কিছুক্ষণ পইড়া হেরপর ঘুমাও।
এমন মধুর কন্ঠের আদরমাখা ডাকটি আজো বড় মিস করি। মাসীমা সাবধানে চলাফেরা করতেও বলতেন। বলতেন, দেশকাল অহন ভালা না। সাবধানে চইল্লো।
দেশকাল আসলেও তেমন ভাল ছিল না। জিয়াউর রহমান হত্যাকান্ডের পর দেশের সার্বিক পরিস্থিতি শহরে যেমন তেমন; গ্রামাঞ্চলে খারাপ হতে লাগলো। ছোটখাট অঘটন শুরু হয়ে গেল। প্রথমে ছেচড়া চুরি, পরে বড় চুরি। সবই বাড়তে লাগলো। তবে মানুষের আতঙ্ক তেমন ছিলনা। আতঙ্ক শুরু হলো ডাকাতি শুরু হওয়াতে। আজ এ বাড়ী তো কাল ও বাড়ী। রাত গভীর হলেই কোন না কোন বড়বাড়ীতে ডাকাত পড়তো। মোটামুটি নিত্যনৈমত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ালো বাড়ীতে বাড়ীতে ডাকাতি।
দিনভর এই নিয়েই সকল জটলায় আলোচনা। মোড়ে মোড়ে জটলা, মোড়ে মোড়ে আলোচনা। সাংঘাতিক মুখরোচক আলোচনা। কঠিন ভীতু মন নিয়ে কথোপোকথন; “আইছিল ২০ জনের মত বড় দল। সবাইর মুখে কাপড় বান্দা। কালা কাপড়। চিনোনের উপায় নাই। রামদা, ছেনী, ডেগার আর ঢেহী সবই নিয়াই আইছিল। ঢেহী দিয়া দরজাডা ভাইঙা ঢুইক্কাই পরথমে মাতবর সাহেবরে ধইর্যা পিঠমোড়া দিয়া বানলো। হেরপর হুতাইয়া হালাইয়া কী মাইরটাই না মারলো। মাইরের ঠেলায় পরথমে পাদ, পরে হাগুও বাইর কইরা দিলো।।”
আমরা হাগু বের হবার ভয়ে দিনে যেমন তেমন; রাতে খুবই অস্থির থাকতাম। ঘরের বাতি নিভিয়ে চুপ করে থাকতাম। কিন্তু চুপ করে থাকলে কী হবে! কথা তো আর থেমে থাকে না। কথা উঠলো। বেশ জোরেশোরেই কথা উঠলো। এক কান দু’কান হয়ে সবকানেই কথা চাউর হলো। ধলা বাজারেও ডাকাত আসবে। কেউ বলছে আজ আসবে। কেউ বলছে কাল। একটা হুরাহুরি পড়ে গেল সবখানে। সবাই সতর্ক হলো। বিশেষকরে সর্তক হলো সদ্য প্রতিষ্ঠিত জনতা ব্যাংক। ওটাই নাকি ডাকাতদের প্রধান টার্গেট।
কিছু একটা করা দরকার। রাতেই রহমত মেম্বারের নেতৃত্বে বড়রা বসে “বাজার পাহারা কমিটি” করে ফেললো। বিশাল কমিটি। ভয় বলতে কথা! ডাকাতির ভয়ে সবাই পাহারা দিতে রাজি। তবে কমিটিতে আমরা বাদ। ছোটদের জায়গা নেই; সব বড়দের নিয়েই করলো। ৪টি দল করা হলো। তিনটি দলের সপ্তাহে দু’দিন করে পাহারা। বাকী বিশেষ দলটির সপ্তাহে একদিন; সোমবার। ঐ দলে কালাম ভাই এবং হানুদার নাম। ভাবলাম সুযোগ একটা যায়। হানুদার ছোটভাই মহসিনের সাথে বুদ্ধি করে সুযোগটা নিলাম। মহসিন আর আমি মিলে তাঁদের দু’জনকে পটিয়ে পাটিয়ে তাঁদেরই প্রক্সি দেয়ার সুযোগ নিলাম।
অপেক্ষায় থাকি। সোমবারের অপেক্ষায়। কিন্তু সোমবার তো আর দিনে দিনে আসে না। সাতদিনে একবার আসে। রাত বারোটাও সহজে বাজে না। যখন বাজতো তখনই নেমে পড়তাম। পড়াশুনা শেষ করে নেমে পড়তাম পাহারায়। একটা উৎসব উৎসব ভাব। আগে থেকে তেল দিয়ে ঘষামাজা করে বানানো লাঠিটা হাতে নিয়ে প্রথমে বটবৃক্ষের তলায় সবাই সমবেত হতাম। কিছুক্ষণ কথাবার্তা হতো। দলে থাকা দু’একজন পন্ডিতমার্কা সদস্যের আতেলমার্কা কথাবার্তা।
তাদের কাছে সাক্ষাৎ তথ্য আছে। ডাকাতি আজকেই হবে। ডাকাতদের বিশাল বহর অলরেডী পাশের গ্রামে দূপুরের খাবারও খেয়েছে। আলুর ভর্তা আর ডালের চড়চড়ি দিয়ে কাওরাবালাম চালের ভাত। চাক্ষুস সাক্ষী; সাক্ষী বিশ্বাস না করে উপায় নেই। আজকে আর রক্ষে নেই। লুঙ্গি কাছা দিয়ে চারটা দলে ভাগ হয়ে বাজারের চারদিকে বেরিয়ে পড়লাম। সবাই একসাথে লাঠি উঁচু করে ধরে বেরিয়ে পড়লাম। আর মুখে রাখলাম পাহারার আওয়াজ। সারা বাংলা মাতানো অতি পরিচিত কোরাসীয় আওয়াজ। ‘অশিক্ষিত’ সিনেমায় নায়ক রাজ রাজ্জাকের মুখে বলা প্রবল জনপ্রিয় আওয়াজ, “বস্তিওয়ালা জাগোরে!!”। চলবে....