ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীনঃ ঈদ তো গেল। মহা ধুমধামের ঈদুল ফিতর। মাহে রমজানের একমাস সিয়াম সাধনার ঈদ। বড় স্বাদের ঈদ; আনন্দের ঈদ। অনেক অনেক আনন্দ বয়ে নিয়ে এসে রাশিরাশি আনন্দ বিলিয়ে দিয়ে গেল। কয়টা দিন কোলাকুলি করতে করতে একটা বড় রকমের ঝড় বইয়ে দিয়ে গেল। প্রাচীন বাংলার মুসলিম সমাজের আদি রূপ এই কোলাকুলি। বন্ধুবান্ধব যার সংগে যেখানেই দেখা; হ্যান্ডশেক করেই জড়িয়ে ধরা। বুকের সাথে বুক মিলিয়ে কোলাকুলি করা। নিজের ঘাড় একবার বন্ধুর ঘাড়ের একপাশে, অন্যবার আরেক পাশে রেখে রেখে ঈদ মোবারক বলা।
ইদানীং এখানেও ভেজাল লেগেছে। অবশ্য ভেজাল কোথায় নেই। ভেজাল তো সব জায়গায়। এ থেকে কোলাকুলিটাও রেহাই পায়নি। কোলাকুলি শুরু করলেই ভেজালটা বাঁধে। মানুষের কারণেই বাঁধে। সমাজে বর্তমানে দুই কিসিমের মানুষ বেরিয়েছে। এক কিসিম বুকের সাথে বুক মিলিয়ে ঘাড় এপাশ ওপাশ করে তিনবার; আগের মতই। অন্য গ্রুপ একবারের পরেই থামিয়ে দেয়। কিন্তু তিনবারে অভ্যস্ত মানুষ থামতে চায় না। সে দ্বিতীয়বারও ঘুরাতে চেষ্টা করে। তবে কখনও পারে; কখনও পারে না।
আমার শোনিম পারে। জোর করে তিনবারই করে। বিষয়টি শোনিম বেশ উপভোগ করে। আগে আরো বেশী করতো। বয়স তখন কতই বা হবে; চার কি পাঁচ। খুব সকালে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠেই বলতো, কী মজা, কী মজা! কোলাকুলির নামাজে যাবো! শোনিম সকালের ঈদের নামাজে যেতই কোলাকুলি করবে এই আনন্দে। ইমাম সাহেব খুতবা শেষ করে কখন মোনাজাত দেবেন; আর মোনজাত শেষে সবাই দাঁড়িয়ে কোলাকুলি করবে।
একবার একেবারে নতুন জায়গার কোন এক মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করলাম। আশেপাশে চেনাজানা পরিচিত কেউ নেই। থাকার কথাও না। বাপ-ব্যাটা চুপচাপ বসে থেকে নামাজ শেষ করলাম। মোনাজাত শেষ হলো। কেউই কোলাকুলি করতে আসলো না। তাতে কি! আমরা দু’জনায় করলাম। কিন্তু শোনিমের মন ভরলো না। সেদিকে ততটা লক্ষ্য না করে মসজিদ থেকে বেরুতে যাবো। কিন্তু শোনিম বের হবে না। কিছুতেই বের হবে না। কোলাকুলি না করে সে মসজিদ ছাড়বেই না।
কোলাকুলি ছাড়া ঈদের নামাজ শেষ হয় কি করে? ওর কঠিন প্রশ্ন। ছোটবেলায় এমনি ভাবনা আমারও ছিল। আমি খুব ভাল করেই বুঝতে শিখেছিলাম, বছরের দু’টো দিনেই কেবল নামাজ শেষে কোলাকুলি করে মুসলিম সমাজ। বাকী সময়ে কখনোই করে না। এমনিতে প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে আদায় শেষেও কখনো কারো মাথায় কোলাকুলির বিষয়টি থাকে না। থাকে কেবল ঈদের নামাজ দু’টিতে। এটাই হলো কালচার। সমাজ এবং ধর্ম মিলেমিশে বানানো বহুদিনের কালচার।
যা মাথায় ঢোকে ছেলেবেলায়; মানুষ হয় অভ্যস্ত। আর মনের মধ্যে পোষন করে আজীবন। তাইতো এটাই কালচার। আর এই কালচার মনের অজান্তেই মানুষ মনের মধ্যে লালন করে। বাসনা পূর্ণ না হলে মন উসখুশ করে। খুব উসখুশ করে। কী যেন হলো না, কী যেন পেলাম না ভেবে ভেবে মন যন্ত্রণায় ভোগে। শোনিমের যন্ত্রণাটাও ওই জায়গায়। আর কিছু পাই বা নাই পাই; ঈদে ওর কোলাকুলি চাইই।
ঈদ আমাদেরকে কোলাকুলি করতে শিখিয়েছে কাছে আসার জন্যে। সকল ভেদাভেদ ভুলে, বৈরিতা ফেলে মিলেমিশে যাবার জন্যে। কোলাকুলির উদ্দেশ্যটি অবশ্যই মহৎ। কোলাকুলি বিষয়টি খুবই অর্থবহ। ধর্মীয় কালচারে যেমনি কোলাকুলি এসেছে, তেমনি সামাজিক কালচারেও এর বার্তা বহমান। বহমান মোটামুটি ভাবে সারা বিশ্বে । জাতি ভেদে কোন কোন জাতিতে এর প্রচলন নেই বটে। তবে পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশী মানুষ এই কোলাকুলিতে অভ্যস্ত। সামাজিক বন্ধন বৃদ্ধির জন্যে কোন না কোন ভাবে দুটো দেহকে কাছে টেনে দুটো মনকে কাছে আনার চেষ্টায় রত।
সমাজ চায় মানসিকভাবে সমাজের সকল মানুষেরা মিলেমিশে চলুক। গলায় গলায় গলাগলি করে চলুক। একটি সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যেই চায়। না হলে সংবেদনশীল সমাজ নষ্ট হয়; শান্তি বিঘ্নিত হয়। সমাজে বিপদ বাড়ে। তবে গলায় গলায় চলাটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছালেও বিপদ। বেশী বাড়াবাড়িতে গলায় গলায় চলাটা আর গলায় গলায় থাকে না। গলা থেকে মুখে চলে আসে। মুখ একটা ড্যাঞ্জারাজ জায়গা। খুব সহজেই ব্যালান্স হারা হয়। মুখের কল্যাণে একটা ‘া’ কার যোগ হয়ে গলাগলি শব্দটি সহজেই গালাগালিতে রূপ নেয়।
জাষ্ট একটা ‘া’ কার এর কী মারাত্মক প্রভাব। পুরো বিষয়টিকেই পাল্টে ফেলে। পাল্টে ফেলে এর ভাব, পাল্টে ফেলে এর অর্থ। পরিস্থিতি একেবারেই জটিল এবং মারাত্মক করে ফেলে। পজিটিভ শব্দটিকে পুরোপুরি নেগেটিভ করে ফেলে। গালি বিষয়টি আসলেই মারাত্মক। এর নানাবিধ রূপ এবং জঘন্যতম ব্যবহার। অযথাই যার তার মুখে যত্রতত্র ব্যবহার। খুবই অন্যায়ভাবে ব্যবহার। আবার এদেশে গালির বাহারও চমৎকার! হাজার হাজার গালির সমাহারে সমৃদ্ধ আমার বাংলা ভাষা। সেসব গালিতে পুরুষের চেয়ে মেয়েদেরকেই টার্গেট করা হয় বেশী। যত গালি এদেশে আছে তার বারোআনা ব্যবহার হয় নিজের নয়; অন্যের মা এবং বোনকে নিয়ে। অবলীলায় ব্যবহার হয়। এমনভাবে ব্যবহার হয় যেন এদেশে মা-বোনের জন্মই হয়েছে গালির টার্গেট হবার জন্যে।
অন্য দেশে আছে কিনা জানি না; তবে জানলে অবাক হবেন, পুরো জাপানী ভাষায় মোটে একটা গালি। বই, পুস্তক, সিনেমা কিংবা গল্প উপন্যাসসহ সামাজিক কালচারের কোথায়ও দ্বিতীয় কোন গালির অস্তিত্ব নেই। একজন জাপানীজ যখন তখন নয়; খুব মারাত্মকভাবে ক্ষেপে গেলে কালেভদ্রে সেই গালিটি দেয়। চোখমুখ লাল করে বলে, ‘খনেএরো বাগা’। যার অর্থ ‘বোকার বাচ্চা বোকা’। কেউ একবার এই গালিটি দিল তো বুঝতে হবে কেইস খুবই খারাপ। খুবই জটিল। এবার আর রক্ষে নেই; প্রচন্ড ক্ষেপেছে মানুষটি।
জাপানে খুব বেশী রেগে গেলে মানুষ কেবল এই একটি মাত্র গালি দেয় বটে। তবে আর এগোয় না। ওখানেই ঘটনার ইতি ঘটায়। কোনভাবেই গালাগালির পরবর্তী ধাপে যায় না। বাংলাদেশে গালাগালির পরবর্তী ধাপও আছে। খুবই সিরিয়াস এই ধাপ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলেই এই ধাপের শুরু। পুটুশ পাটুশ দিয়ে শুরু। শব্দ শুনলেই মানুষ বুঝতে পারে, গোলাগুলি শুরু হয়েছে। গালাগালির পরবর্তী ধাপ হলো গোলাগুলি। মজার ব্যপার হলো, দুটোই মুখ দিয়ে দিতে হয়। গালাগালি দিতে লাগে মানুষের মুখ। আর গোলাগুলিতে লাগে অস্ত্রের মুখ।
শরীরে লুকিয়ে রাখা অস্ত্র হঠাৎ করে বের করে পুটুশ পাটুশ কয়েকটা ফুটিয়ে দেয়। ত্রিশ বছর আগেও ঠিক এমনটা ছিল না। ছিল ছুড়ি, ডেগার কিংবা রামদা জাতীয় কিছু। ওসব নিয়েই ফাটাফাটি করতো। করতো কোপাকুপি। এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের উপর ঝাপিয়ে পড়তো। এখন ঝাপাঝাপির এত ঝামেলায় যায় না। শরীরের লুকিয়ে রাখা জায়গা থেকে বের করে জাষ্ট ট্রিগারে আঙুল। লক্ষ্য প্রথমে গায়ে, পরে আকাশে। তবে আকাশ কোন টার্গেট নয়। আকাশে ফুটায় কেটে পড়ার আগে আগে।
গগন বিদারী শব্দে গুলি হাওয়া হয় বাতাসে; আর তারা হয় জনারণ্যে। এহেন ঘটনা নিত্যদিন ঘটছে সমাজের আনাচে কানাচে। এতটাই ঘটছে যে, এটা নিয়ে এখন আর কেউ তেমন ভাবে না। সয়ে গেছে সবার গায়ে। এখন রাস্তায় গাড়ীর চাঁকা পাংচার হলেও মনে করে এটা গুলির আওয়াজ। ত্রিশ বছর আগে গুলির আওয়াজ হলেও প্রথমে সমাজ ভাবতো এটা চাকা পাংচারের শব্দ।
আমার আজকের লেখার মূল প্রতিপাদ্যও এই প্রায় সমোচ্চারিত শব্দ। যার শুরু গলাগলি দিয়ে; আর শেষ গোলাগুলি নিয়ে। খুবই কাছাকাছি তিনটি শব্দ। শুধু ‘া’ কার, ‘উ’ কার, এবং ‘ে া’ কার লাগিয়ে দিলেই রূপ এবং অর্থ পাল্টে যায়। ভয়ানক ভাবে পাল্টে যায়; বিপদজনক অর্থ প্রকাশ পায়। কী বিচিত্র এই সমাজ! কী বিচিত্র সমাজের তৈরী করা শব্দগুলো!! খুবই কাছাকাছি এদের অবস্থান। ডিকশনারীতেও যেমনি, তেমনি সমাজেও!!!