হারানো শৈশব; কুড়ানো সেই সব!! (৫৩ তম পর্ব)

প্রকাশের সময় : 2019-04-11 17:15:12 | প্রকাশক : Administration হারানো শৈশব; কুড়ানো সেই সব!! (৫৩ তম পর্ব)

ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীনঃ কঠিন এই পৃথিবী থেকে চির বিদায়ের কারণে কোনদিনই আর পাবো না তাঁর পরামর্শ কিংবা ভালমন্দের আদেশ-নিষেধ। একজন সাধারণ মানুষ সর্বোচ্চ যতটা ভাল হতে পারেন, তিনি যেন তারচেয়েও বেশী ভাল ছিলেন। কড়া স্বভাবের ছিলেন না মোটেও। তাঁর সময়ে তাঁর মত এতটা ঠান্ডা টাইপের মানুষ কেবল আমরা নই; আশেপাশের কেউ কোনদিন দেখেছে বলেও শুনিনি। বলা যায় ঠান্ডা প্রকৃতির মানুষের জীবন্ত প্রতিভু আমার বাবা।

আব্বার সাবধানী বাণীময় পত্রখানা মাথায় রেখেই শেষ করি অপ্রত্যাশিতভাবে অনুষ্ঠিত ত্রৈমাসিক পরীক্ষা। কোনমতে সামাল দেই। বরাবরের মত এবার ফলাফলের অপেক্ষা নেই। থাকার কথাও না। তবে পরীক্ষার পর বেশী সময় নেননি কোন স্যারই। খুব তাড়াতাড়ি সময়ের মধ্যেই রেজাল্ট দেয়া শুরু করলেন। একেক দিন একেক স্যার বগলতলে করে খাতার বান্ডিল নিয়ে হাজির হন। এর আগে এই খাতা নিয়ে সব সময় আমার খুব আগ্রহ থাকতো। কলিজা ধুকধুক করতো। কত পাবো তা নিয়ে ধুকধুক নয়; হাইয়েষ্ট মার্ক পাবো কিনা এই নিয়েই ধুকধুক।

ধুকধুকটা বাড়াতো নিজাম ভাই। মোড়ল বাড়ীর নিজাম ভাই। সালাম স্যারের আপন ছোটভাই। বয়সের ভারে ইদানীং ন্যুজ হলেও তখনকার চেহারা ছিল বেশ। টকটকা ফর্সা গড়নের যুবক। কথাবার্তায় সর্বদা চাঞ্চল্য; কিন্তু স্বভাবে খুবই সরল সহজ এবং কিছুটা পাগলাটে। ক্লাশ না নিলেও এইট পর্যন্ত আমাদের কোন না কোন খাতা মার্কিং করতেন সালাম স্যার। আর নিজাম ভাইয়ের কাজ ছিল গোপনে খাতা দেখে অগ্রিম এসে আমাদেরকে নাম্বার বলে দেয়া।

বলার সময় সে কী ভাব তার! বাজারে এসে নিজে থেকেই খুঁজতেন আমরা কে কোথায়। আমাকে পেলেই প্রথমে মুচকী হাসি। অর্ধেক দাঁত বের করা মুচকী হাসি। তারপর অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতেন। ধুকধুক বক্ষে তার কাছে যেতাম। এবার তিনি যেন চেনেনই না আমায়। অনেক পিড়াপীড়ির পর বলতেন, খবরতো বেশী ভালা না সরদার। এই বলেই চুপ। এরপরে আবার ধুকধুক। নাহ! তিনি আর কিছু বলেন না। শুধু চলে যাবার আগে বলতেন, দুই সংখ্যার নাম্বার পাইছো। শেষেরটা দেখবার পারছি। মনে হয় ৬। বাড়ীত গিয়া প্রথমটা আবার দেখবাম।

সাধারণত প্রথমদিনের রেজাল্ট পেতাম কার্তিক স্যারের কাছ থেকে। এবারও তাই হলো। খাতা নিয়ে আসলেন স্যার। ইংরেজী ২য় পত্রের খাতা। চারপাঁচ জনার পরেই আমার খাতা। মুচকী হাসি দিয়ে স্যার খাতা দিলেন। হাইয়েষ্ট মার্ক। নাম্বারটা এখনো জ্বলজ্বল করছে; ৬১। স্যার খুশী। খুশী আমিও। বরাবর তো হাইয়েষ্ট মার্কই পাই। এবারও পেলাম। ভেঙে পড়ে পড়ে ধরণের বড় সেই আস্ত আকাশটা যেন মাথা থেকে সরে গেল। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম।

এতদিনকার আনচান করা মন আসলেই স্বস্তি পেয়েছে। খুব খারাপ অবস্থা থেকে পরিত্রান পেলে যেমনি স্বস্তি পায়, ঠিক তেমনি স্বস্তি। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। ভাবলাম রেজাল্টটা একটু এনজয় করা দরকার। আফটার অল রেজাল্ট ভাল করেছি। একটা ভাবের বিষয় আছে না! যেই ভাবা সেই কাজ। বিকেলের ফুটবল খেলা শেষে বাসায় কিছুক্ষণ পড়াশুনা করে মিডনাইট শো দেখতে সদলবলে আবার বালিপাড়ার চিত্রপুরী।

ফারুক-ববিতার ছবি; গোলাপী এখন ট্রেনে। সারা বাংলায় দারুণ হিট ছবি। আমজাদ হোসেনের কালজয়ী বক্তব্যধর্মী ছবি। সেকেন্ড ক্লাশের টিকিট কেটে ছবি শুরুর পর চুপিচুপি ফার্স্টক্লাশে এসে বসেছি। খুব সাবধানে বসেছি যেন হলের লাইটম্যান না দেখে। কাজটা আমি প্রায়ই করতাম। কিন্তু আজকে করেও তেমন মজা নেই। কঠিন গরমে হলে বসা দায়; তবুও চোখ বড় বড় করে পর্দায় তাকিয়ে দেখছি; আর অপেক্ষা করছি মানুষের মুখে মুখে ফেরা গানটির দৃশ্যায়ন দেখার; হায়রে কপাল মন্দ চোখ থাকিতে অন্ধ! এ জীবন জ্বইলা পুইড়া শেষ তো হইলো না!!!

ছবি শেষ হলেও মনের আনন্দ শেষ হলো না। দু’দিন বাদে শংকর বিএসসি স্যার পদার্থ বিজ্ঞানের খাতা নিয়ে এলেন। টিপটপ পরিপাটি ড্রেসে নিয়মিত স্কুলে আসা শংকর স্যার। ইস্ত্রি করা হাফহাতা শার্টের সাথে ঘিয়া কালারের প্যান্ট। দারুণ স্মার্ট লাগতো স্যারকে। ময়মনসিংহ থেকে রোজ ভোরের ট্রেনে আসতেন ধলায়। সেদিন ক্লাশে এসেই কালো ফ্রেমের ভারী চশমাটা টেবিলে রেখে এদিক ওদিক তাকালেন।

খুঁজলেন মল্লিকাকে। খুঁজবেনই তো। মল্লিকা হাইয়েস্ট মার্ক পেয়েছে; ৬৪। আমি কিছুটা দমে গেলাম। তবে ঘাবড়ালাম না। সব পেপারে আমি হাইয়েস্ট মার্ক পাবো এমনও তো নয়।

পর্দাথ বিজ্ঞানে পেলাম না। এটা দূর্ভাগ্য নয়! দূর্ভাগ্য কত পেলাম তা নিয়ে। পেলাম ৪৭; পঞ্চাশেরও কম। জীবনে এই প্রথম এত কম নাম্বার পেলাম কোন সাবজেক্টে। একেবারেই অনভ্যস্ত এই আমি পরিস্থিতির মোকাবেলায় আঁতকে উঠলাম। আঁতকে উঠলো ক্লাশের সবাই। যেন একটা কঠিন ধাক্কা খেল পুরো ক্লাশ। ক্লাশ ওয়ান থেকে আমাকে এমনি খারাপ রেজাল্ট করতে কেউ দেখেনি। কোনদিন দেখেনি।

এবার দেখলেন। শংকর স্যার আড় চোখে দেখলেন আমায়। স্যারের মনটাও খুব খারাপ। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে নীরবতা ভাঙলেন। আমার খাতাটা হাতে নিয়ে আবার ভেতরটা দেখলেন। এবং টেবিলের উপর রাখতে রাখতে গম্ভীর মুখে বললেন, নাইনে উঠতে না উঠতেই তুমি যেন কেমন হয়ে গেলা। উল্টো পথ ধরলা। এখনও সময় আছে। উল্টো পথে চলা ছাড়ো। যদি আজকের পাওয়া এই নাম্বারটা উল্টাতে চাও, তাহলে চলাফেরাটাও উল্টে ফেল। খুব তাড়াতাড়ি ফেল।

উল্টাবার আর সময় পেলাম কই! পরেরদিন জব্বার স্যার হাজির। ফার্স্ট পিরিয়ডেই আসলেন। আসলেন  ইংরেজী ফার্স্টপেপার খাতা নিয়ে। এসেই আমাকে ডাকলেন; সরদার এদিকে আয়। শরীলডা আইজ ভালা না। সবাইরে ডাইক্কা ডাইক্কা খাতাগুলা তুই দে। আমি এক এক করে ডাকছি। মল্লিকা, মোশাররফ, হান্নান সবাইকে ডাকা শেষ। খাতাও প্রায় শেষ। কিন্তু আমারটা এখনো আসে না। বিষয়টা বুঝলাম না। ভাবনায় পড়লাম। আর ভাবতে ভাবতেই অবশেষে আসলো। একবারে শেষে আসলো।

আমার হাত কাঁপছে। পা ও কাঁপছে। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। আমি নাম্বারের দিকে তাকিয়ে আছি। না পারছি চোখ ফেরাতে; না পারছি মুখ ফুটে বলতে। সবাই চুপ। জব্বার স্যারও চুপ। একটা পিনপতন নীরবতার মধ্য দিয়ে সময়টা যাচ্ছে। অবশেষে স্যার নিজেই নিরবতা ভাঙলেন। বললেন, এবার বল্। নিজের মুখেই বল্। অবশেষে সব সময় প্রায় অধিকাংশ সাবজেক্টে হাইয়েস্ট মার্ক পাওয়া ছাত্রের জীবনে প্রথম ফেল করার ঘোষণা তার মুখ থেকেই সবাই শুনলো।

৩১ পেয়েছিলাম! দুই নাম্বারের জন্যে ইংরেজী প্রথম পত্রে পাশ মার্কটাও তুলতে পারিনি। ইজ্জত আর রইলনা! ইজ্জতের বাকীটা গেল ইলেকটিভ ম্যাথ, মানে ঐচ্ছিক গণিতে। ১৬ জনের খাতা নিয়ে মূসা স্যার ক্লাশে এলেন। বিজ্ঞান গ্রুপে আমরা মাত্র ১৬ জন্য শিক্ষার্থীই ছিলাম। তাই সবার খাতা বিলি করতে সময় লাগলো না তেমন। হাইয়েস্ট মার্ক পেল মোশাররফ। তেমন ভাল না; ৫৩। এক এক করে সবার ফলই ঘোষিত হল। কিন্তু মোশাররফ ছাড়া আর কেউই পাশ করতে পারলো না। আমি পেলাম ১৮। ১৬ জনের মধ্যে ১৬তম!

ক্লাশ ওয়ান থেকে বরাবর প্রথম হওয়া এই আমি জীবনে প্রথম মেধা তালিকায় প্রথম হতে পারলাম না। দুই দুইটা পেপারে ফেল করলে সেটা পারার কথাও না। না হোক সেটা ফাইনাল পরীক্ষা। অথবা হোক সেটা ত্রৈমাসিক। পরীক্ষা তো পরীক্ষাই! রেকর্ড হয়ে গেল দুই পেপারে ফেল; রেকর্ড হয়ে গেল ফার্স্ট না হবার কথা। হলাম পঞ্চম। হবারই কথা। গেল কয়েক মাসে স্কুলের নানা অপকর্মের পঞ্চতান্ডবের একজন হিসেবে পঞ্চপান্ডব তো হবারই কথা। চলবে....