রেলের উন্নয়নে অর্থনৈতিক বিপ্লবের অপার সম্ভাবনা

প্রকাশের সময় : 2019-03-27 18:11:38 | প্রকাশক : Administration

আর নয় মহাসড়ক! এবার রেল ও নৌপথে নজর দিতে হবে। বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের একজন কল্যাণকামী ও দূরদর্শী শাসকের মুখ থেকে এমন পরিকল্পনা ও প্রত্যয়ের কথা শোনার জন্য যেন আমি মুখিয়ে ছিলাম সেই কিশোর বয়স থেকেই। রেল পরিবারের একজন সদস্য এবং এর সঙ্গে আমার নাড়ির টানের কারণেই দেশে একটি অত্যাধুনিক রেল ব্যবস্থা চালুর স্বপ্নটা আমাকে পেয়ে বসেছিল স্বাধীনতা-উত্তরকাল থেকে, এর পীড়াদায়ক দুরবস্থার কারণে।

১৯৬৮ সালে প্রাইমারীর ছাত্রাবস্থায় বাবা-মার সঙ্গে প্রথম শ্রেণীর আরামদায়ক রিজার্ভেশন সেলুনে সৈয়দপুর থেকে চট্টগ্রাম পাহাড়তলী প্রথম ট্রেন যাত্রার যে মনোমুগ্ধকর স্মৃতিটি আজও আমার স্নায়ুতে সুখের দ্যোতনা জাগায় তা আর কখনও ঘটেনি জীবনে, স্বাধীনতা-উত্তরকাল থেকে আজ পর্যন্ত। আশির দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সৈয়দপুর থেকে ঢাকায় ট্রেনে যাওয়া-আসার সময় বাহাদুরাবাদ-ফুলছুরি ঘাট পারাপারের যে বিড়ম্বনা পোহাতে হয়েছে, তার প্রেক্ষিতে আমি তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতাম একটি অত্যাধুনিক রেল ব্যবস্থার। আমার এই স্বপ্নের কথা আমি তখন থেকেই বারবার লিখেছি গণমাধ্যমে। আশা ছিল জনবান্ধব উন্নয়নকামী সরকার বা একজন দূরদর্শী শাসক ক্ষমতায় এলে আমার এ স্বপ্ন একদিন বাস্তবায়ন হবেই। সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো এতদিনে। বাংলাদেশে অতি সম্ভাবনাময় ও টেকসই যত লাভজনক খাত রয়েছে, তার মধ্যে রেল একটি। এর আগে কোন সরকারই বিষয়টিকে তেমনভাবে প্রাধান্য দেয়নি বললেই চলে। তাই এ পর্যন্ত এটি লোকসানের ভারে জর্জরিত হয়ে জাতির দুর্বহ বোঝায় পরিণত হয়েছে অথচ মনোযোগ দিলে এই একটি খাতই বাংলাদেশের ভাগ্য পরিবর্তন করে দিতে পারে। ১৭/১৮ কোটি মানুষের বাংলাদেশ; এই খাতটির জন্য একটি বিশাল বাজার। এর অর্ধেক ভোক্তা বা যাত্রী যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে এর বাণিজ্যিক (যাত্রী, সেবা ও পণ্য পরিবহন) সম্ভাবনা একটি স্বর্ণ দুয়ার খুলে দিতে পারে।

গোটা বিশ্বে সবচেয়ে নিরাপদ পরিবহন হিসেবে স্বীকৃত রেল ভ্রমণ। এই রেল ভ্রমণ আরামদায়ক ও নিরাপদ বলে যাত্রী সাধারণের কাছে এর অগ্রাধিকার সবার আগে বিবেচিত। বাংলাদেশে যদি রেল ভ্রমণকে সুলভ, নির্ভরযোগ্য, আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্যদায়ক এবং নিরাপদ ও দ্রুতগামী করা যায় তাহলে এর কোন বিকল্প নেই। ফলে বহু মানুষের প্রাণ রক্ষা এবং নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যে ভ্রমণের স্বস্তিতে কৌতূহলী শখের যাত্রীও বাড়তে পারে বহুগুণ তার সঙ্গে। এর ফলে সড়ক পরিবহনের ওপর বিড়ম্বনাকর অসহনীয় চাপ এমনিতেই কমে আসবে। সড়ক দুর্ঘটনার হার অস্বাভাবিকভাবে কমবে। সড়ক কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সিন্ডিকেট অপশক্তির অবাধ দৌরাত্ম্যের লাগাম টেনে ধরা সহজ হবে।

পরিবহন শ্রমিক ও মালিকদের সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি মানুষ তাদের স্বেচ্ছাচারিতা ও নৈরাজ্যকর অবস্থা সৃষ্টির সুযোগ থেকে বহুলাংশে রক্ষা পাবে। সাধারণ মানুষ ও যাত্রী ব্যাপকভাবে ট্রেন নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। ভ্রমণ নির্বিঘ্ন ও স্বাচ্ছন্দ্যময় হলে মানুষ পরিবার-পরিজন বা প্রিয়জন নিয়ে ভ্রমণে আগ্রহী হবে। সংখ্যায় নতুন যাত্রী যোগ হবে। আরামে ভ্রমণে চিত্তের স্বস্তি বা অবসর বিনোদনের সুযোগ পেলেই মানুষ শখে ট্রেনভ্রমণ করবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। রেলের আয় বাড়বে বহুগুণ। যুগ যুগ ধরে লোকসান ও চুরি-বদনামের খাতা থেকে কেটে যাবে রেলের নাম যদি সুব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায়।

এর জন্য চাই খোল-নলচে পরিবর্তনের মতো আমূল সংস্কার ও মেগা পরিকল্পনা। কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য সবার আগে নিতে হবে সংস্কারের পদক্ষেপ। প্রথমেই দেশব্যাপী ঘণ্টায় দেড় শ’ থেকে দুই শ’ কিলোমিটার বেগেচালিত আধুনিক কার্বনমুক্ত ও পরিবেশবান্ধব বৈদ্যুতিক ট্রেন চলাচলের উপযোগী রেলসড়কের অত্যাধুনিক নেটওয়ার্ক ও সিগন্যাল সিস্টেম নির্মাণ করতে হবে। পর্যাপ্ত যাত্রী পরিবহনের জন্য সাধারণ উচ্চতার দোতলা ট্রেন যা ইউরোপে প্রচলিত, তা আমদানি করা যেতে পারে। এর ব্যবহার ঈদ এবং নানান সময় বাড়তি যাত্রীর চাপ সামলাতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

নানা প্রয়োজনে গোটা দেশের মানুষের রাজধানী ঢাকামুখী হওয়ার ব্যাপক প্রবণতা এই নগরটিকে সবদিক দিয়েই বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছে। বাড়ছে মানুষ, বাড়ছে বাসস্থান সঙ্কট ও বাসা ভাড়া, বাড়ছে জীবনযাত্রার অসহনীয় ব্যয়ভার ও নানান সঙ্কট। বাড়ছে হাজারো সমস্যা পরিবহন সঙ্কট ও বিড়ম্বনা, যানজট, অপরাধ ইত্যাদি। তারপরেও সরকারের নেই রাজধানীকেন্দ্রিক সকল মন্ত্রণালয় ও গুরুত্বপূর্ণ সরকারী অফিস-আদালত বিকেন্দ্রীকরণের কোন সুদূরপ্রসারী সুপরিকল্পনা। ফলে রাজধানীতে কেন্দ্রীভূত হওয়া সকল দুর্বিষহ সমস্যার কোন হাল করা যাচ্ছে না। উপরন্তু তা দিনে দিনে জটিল অবস্থার রূপ নিচ্ছে।

এক্ষেত্রে সুইডেনের বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থার মডেলটি অনুসরণ করা যেতে পারে, তা করা হলে গণপরিবহন হিসেবে ট্রেননির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থা এনে দিতে পারে এর অনেকটা সহজ সমাধান। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে এর চতুর্পার্শ্বের নিকটবর্তী শহরগুলোর সঙ্গে যেমন নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জের মতো শহরগুলোর সঙ্গে ঘন ঘন দ্রুতগামী ট্রেন সার্ভিস চালু করা যায় তাহলে  মানুষ সর্বোচ্চ একঘণ্টার মধ্যেই ঢাকা যাওয়া-আসার সুবিধা নিয়ে দিনের কাজ দিনে সেরে সন্ধ্যায় ঘরের মানুষ ঘরে ফিরে স্বল্প ব্যয়ে আপন গৃহে শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন নির্বাহ করতে পারে।

সরকারের দেয়া আশ্বাস অনুযায়ী দেশের মানুষ এখন অধীর আগ্রহে স্বপ্ন দেখছে মাত্র ৫৭ মিনিটে ঢাকা-চট্টগ্রাম ভ্রমণের সুযোগটি কবে বাস্তবায়ন হবে! তাহলে ঢাকার সঙ্গে নিকট ও দূরবর্তী জেলা, শহর ও উপশহরের সঙ্গে দ্রুতগামী ট্রেন যোগাযোগের নেটওয়ার্ক তৈরি হলে দেশ ও দেশের মানুষকে তা কতটা উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে, বিষয়টি অনুমান করা মোটেও কষ্টকর নয়।

এই মেগা পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন ও কার্যকর করা গেলে রাজধানী ঢাকায় অবস্থানে বাধ্য দূরের নিরুপায় ছাত্রছাত্রী, ব্যবসায়ী, সরকারী-বেসরকারী চাকরিজীবী বা অন্য যে কোন পেশার মানুষের আর ঢাকায় বসবাসের প্রয়োজন হবে না। ফলে ঢাকা শহরে দিনে দিনে বৃদ্ধি পাওয়া আকাশচুম্বী বাসা ভাড়া, ব্যয়বহুল জীবন ও বাসস্থানের সঙ্কট এবং দুর্বিষহ যানজটের আর অবকাশ থাকবে না।

আমি ইউরোপ ছাড়াও কলকাতায় দেখেছি, সেখানকার বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার দূর অঞ্চলের মানুষ সুলভ ও সুবিধাজনক ট্রেন সার্ভিসের সুবিধা নিয়ে সকালে কলকাতা শহরে পৌঁছে দিনের সকল কাজকর্ম সেরে সন্ধ্যায় ঘরের মানুষ ঘরে ফিরে যাচ্ছে। এতে কাউকে আর রাজধানী বা ব্যস্ততম ব্যয়বহুল শহরে পড়ে থাকা লাগছে না। ফলে শহর থাকছে এই বাড়তি মানুষের চাপ ও সমস্যা থেকে মুক্ত।

সরকারের পক্ষে এই মেগা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব না হলে ইউরোপের অনেক বড় দেশের মতো সরকার বিদেশী উদ্যাক্তার হাতে রেলকে দীর্ঘমেয়াদে লিজ দিতে পারে। এই ব্যবস্থা সুইডেন, নরওয়ে, ইংল্যান্ড, ফ্রান্সসহ বহু দেশে গ্রহণ করা হয়েছে।

রেল হতে পারে গণমানুষের নির্ভরযোগ্য সঙ্গী। রাষ্ট্রের জন্য তা হবে গর্ব ও সুনামধারী জনবান্ধব একটি মডেল প্রতিষ্ঠান। যদি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি রোধ ও সেবামূলক ব্রত নিয়ে আধুনিক