আকাশ থেকে পদ্মাসেতু

প্রকাশের সময় : 2019-02-28 14:57:11 | প্রকাশক : Admin আকাশ থেকে পদ্মাসেতু

মাহমুদ মেননঃ পাখির ডানা মেলে তখন পদ্মার আকাশে চোখ মেলেছে টিম সারাবাংলা। শীতের সোনারোদ ঝিলিক মারছে নদীর বুকে। এরই মাঝখান দিয়ে নদীকে এ ফোঁড়-ও ফোঁড় করে দিয়ে চলে গেছে একটি পথ। সে পথে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বেশকিছু পিলার। ক্রমেই বড় হতে থাকে চোখ। ঘনিয়ে আসে দৃষ্টিসীমা। তাতে নজরে পড়ে রূপালি নদীর বুকে আরও রূপালি এক অবয়ব, স্বপ্নের পদ্মাসেতু।

এবার সেতুর পাটাতনে নেমে আসে টিম সারাবাংলা। এটি জাজিরার অংশ। প্রথম পাটাতন দিয়ে চলে যাবে সড়ক পথ। নিচে দ্বিতীয় পাটাতনে বসছে রেল লাইনের স্ল্যাব। সেখানে ধুন্ধুমার কাজ চলছে। শ্রমিকরা জানালেন ১১২টি স্ল্যাব এরইমধ্যে বসে গেছে।

আর সেতু প্রকল্পের উপ-সহকারী প্রকৌশলী হুমায়ূন কবির জানালেন, স্ল্যাবগুলো তৈরি হচ্ছে ওয়ার্কশপে। সেখানেই পুরোপুরি প্রস্তুত করে বার্জে করে বয়ে আনা হয়। এরপর ক্রেনের সাহায্যে তোলা হয় সেতুর পাটাতনে। সেতুর নিচের পাটাতনে মাঝ বরাবর বসিয়ে দেওয়া হয়               স্ল্যাবগুলো। এগুলোর ওপর দিয়ে বয়ে যাবে একটি ব্রজগেজ রেলওয়ে। আর সেতুর রেল পাটাতন থেকে সড়ক পথের পাটাতনের মাঝে যে উচ্চতা, তাতে রেলপথে দুই স্তরের কনটেইনার পরিবহন করা যাবে।

এরআগে সেতুর এ পর্যন্ত যতটুকু অগ্রগতি, তা তুলে ধরছিলেন এই উপ-সহকারী প্রকৌশলী। জানাচ্ছিলেন, প্রায় ৬০ শতাংশ কাজ এরইমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।

বিশাল ওয়ার্কশপে বিপুলকায় কয়েকটি পাইল প্রস্তুত হয়ে রয়েছে পদ্মার গভীরে প্রোথিত হওয়ার অপেক্ষায়। কোনো কোনোটি তৈরির কাজ এগিয়ে চলেছে। সব কাজই কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত অত্যাধুনিক মেশিনে সম্পন্ন হচ্ছে। ওয়ার্কশপে সে অর্থে শ্রমিক নেই বললে চলে। মেশিন কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। তদারকিতে বসে আছেন দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীরা। লেজার দিয়ে কাটা হচ্ছে ইস্পাত। কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত সে মেশিন একের পর এক খাঁজ কেটে যাচ্ছে নির্দিষ্ট ব্যবধানে।

ওয়ার্কশপে দেখা গেলো, একসঙ্গে এগুচ্ছে পাইল ও স্প্যান তৈরির কাজ। ওয়ার্কশপের বাইরের দিকে পদ্মার তীর ঘেঁষে দেখা গেলো দুটি স্প্যান পুরোপুরি প্রস্তুত। তাতে সূর্যের আলো পড়ে চিকচিক করছে। অদূরে স্প্যান বহনকারী বিপুলাকায় সাদা রঙের ক্রেনটি রয়েছে নোঙ্গর ফেলে। এরই মধ্যে পদ্মা সেতুর ৭টি পিয়ারের ওপর ৬টি স্প্যান বসে গেছে। জাজিরা অংশে পিয়ার নম্বর ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০, ৪১ ও ৪২-এর ওপর বসেছে ছয়টি স্প্যান। সে অংশে প্রতিটি স্প্যান ১৫০মিটার হিসাবে নদী পথে পদ্মাসেতু বিস্তৃত হয়ে রয়েছে ৯০০ মিটার পর্যন্ত।

এদিকে মাওয়া অংশে পিয়ার নম্বর ৪ ও ৫-এর ওপর বসেছে আরও একটি ১৫০ মিটার দীর্ঘ স্প্যান। কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যমতে, এরই মধ্যে মাওয়া অংশে পিয়ার ২ ও পিয়ার ৩ পুরোপুরি প্রস্তুত। তাতে দুটি স্প্যান বসানো হলে এই অংশে ৪৫০ মিটার পর্যন্ত আকার পাবে সেতু। এছাড়া, মাঝামাঝি অংশে মডিউল-৩-এ পিয়ার ১৩, ১৪ এবং পিয়ার ১৬ ও ১৭ পুরোপুরি প্রস্তুত রয়েছে। এতেও বসানো যাবে আরও দুটি স্প্যান। যা বসানো হয়ে গেলে সেতুর মোট কাঠামো বাড়বে আরও ৩০০ মিটার।

কর্তৃপক্ষের গ্রিন সিগন্যাল পেলেই অন্তত দুটি স্প্যান বসানোর জন্য পদ্মার তীর পুরোপুরি প্রস্তুত। সংশ্লিষ্টরা জানালেন, শীত মওসুমে নদীতে চর জেগেছে। চর কাটার কাজ চলছে। সে কাজ শেষ হলেই বসানো হবে এ দুটি স্প্যান। আর সেগুলো বসানো হয়ে গেলে ২০১৯ সালের প্রথম এক দুই মাসেই পদ্মাসেতু বিস্তৃত হবে দেড় কিলোমিটারেরও বেশি পথ।

এসব কর্মযজ্ঞ দেখতে দেখতে টিম সারাবাংলা আবার উঠে আসে আকাশে। দৃষ্টি বিস্তৃত করে দেখে আসে ওপাড়ে জাজিরা পয়েন্টে সেতুর টোল প্লাজা ছাড়িয়ে লিংক রোডসহ সব কিছু প্রস্তুত। এপাড়ে ওয়ার্কশপের বিস্তীর্ণ মাঠ পেরিয়ে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকা পিলার। সড়ক পথে মাওয়া ছাড়িয়ে অনেকদূর পর্যন্ত চলছে নানান কর্মযজ্ঞ। ক্রমেই পদ্মা সেতু দীর্ঘ হচ্ছে। দেড় শ’ মিটারের একটি একটি করে জাজিরা প্রান্তেই ছয়টি স্প্যান বসে গেছে। তাই ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে পদ্মা সেতু। এরই মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতুর অগ্রগতি আরেক ধাপ এগিয়ে গেল। সেতুর এই অগ্রগতিতে খুশি পদ্মা পারের মানুষ।

জাজিরার বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘জীবনে আমরা যা দেহি নাই, তা দেখতাছি। পদ্মায় এই বড় সেতু বানাইতে যে, কত ধরনের বড় বড় যন্ত্রপাতি কাজ করতাছে, তা দেইখ্যা টাশকি লাগার মতন। অনেক অনেক ভাললাগা, বুঝাইতে পারতাছি না। আমরা আগাইয়া যাইতাছি। শেখের বেটি আমাগো ভাগ্য খুইল্যা দিছে।’

নাসিম মিয়া বলেন, ‘যা দেখতে পাইতাছি, তা কোনদিন কল্পনাও করি নাই। এই চরের মধ্যে যেই সব কাজ হইতাছে, হেইগুলি সব কইতে পারুম না, তয় এইটা বুঝতাছি পদ্মা সেতু খুব মজবুত কইরা বানাইতাছে। এমুন বড় নদীরে মধ্যেই এত মজবুত সেতু হইতে পারে ভাবতেও পারি নাই। এই সেতু আমাগো ভাগ্য বদলাইয়া দিতাছে। আর এই সেতুর কারণে আমাগো জাগা জমির দাম বাইরা গেছে। আমাাগো এই গ্রাম শহর হইব। -নির্বাহী সম্পাদক, সারাবাংলা