উত্তরবঙ্গের মাটির নিচে সোনারুপা!

প্রকাশের সময় : 2019-02-14 16:07:03 | প্রকাশক : Admin

এস এম মাহবুবুল আমীনঃ রংপুরের বড় পাহাড়পুর অঞ্চলের ভিত্তিশিলায় খনন কূপ এউঐ ৫৪ এ অল্প পরিমাণ সোনার উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩৬৫ মিটার গভীরে অবস্থিত এই ভিত্তিশিলা মূলত ডায়োরাইট। প্রথমে অস্ট্রেলিয়ায় ও পরে ফিনল্যান্ডের দুটি গবেষণাগারে অধিকতর পর্যবেক্ষণের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে ৪৭৮ মিটার গভীরতার ডাইকটিতে সোনার উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

ডাইকটিতে সোনা, তামা, লোহা ও সিসার আকরিকের উপস্থিতি রয়েছে, এগুলো বেশির ভাগই সালফাইড গোত্রের। গবেষণায় ধারণা করা হচ্ছে, সোনার ভাগ বেশি আছে, এমন অংশটি আছে ভিত্তিশিলার আরও গভীরে। গবেষণাটির জন্য ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর থেকে পাওয়া নমুনায় শিলার পরিমাণ কম হওয়ায় এ সম্পর্কে বিশদ ধারণা পাওয়া সম্ভব হয়নি। ভবিষ্যতে জিডিএইচ ৫৪ খনন কূপের পূর্ণ গভীরতায় শিলাগুলোর যথাযথ বিশ্লেষণ ও নিকটবর্তী এলাকায় আরও কূপ খনন করে গবেষণা কার্যক্রম চালানো হলে সোনা ও অন্যান্য খনিজ পদার্থের প্রকৃতি, সৃষ্টি ও বিস্তার সম্পর্কে বিশদভাবে জানা সম্ভব হবে।

অতীতে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের উত্তর- পশ্চিমাঞ্চলের ভিত্তিশিলায় (base rock) সোনা, রুপা ও অন্যান্য খনিজ পদার্থের উপস্থিতি আছে বলে খবর বেরিয়েছে। কিন্তু সেগুলো মূলত শোনা কথা, কোনো বৈজ্ঞানিক জার্নালে এ বিষয়ে তথ্য উপাত্তভিত্তিক কোনো লেখা প্রকাশিত হয়েছে বলে জানা যায়নি।

প্রকৃতপক্ষে, পর্যাপ্ত নির্ভরযোগ্য আলামত বা তথ্য উপাত্ত ছাড়া ভূ-অভ্যন্তরে অথবা ভিত্তিশিলায় কোনো নির্দিষ্ট খনিজের মজুত রয়েছে এমন বক্তব্য বিভ্রান্তিকর ও অগ্রহণযোগ। কোনো অঞ্চলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিশদ গবেষণার পরেই শুধু সোনা, রুপা বা অন্যান্য খনিজ পদার্থের উপস্থিতি, বিস্তৃতি ও ভূতাত্ত্বিক উৎপত্তি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে। গবেষণায় কোনো খনিজের উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পরেই শুধু তার মজুত নির্ণয়ের প্রশ্নটি আসে।

বাংলাদেশে পাললিক শিলাস্তরের নিচে রূপান্তরিত জমাটবদ্ধ আগ্নেয় শিলাস্তরটি ভিত্তিশিলা অথবা কঠিন শিলা নামে পরিচিত। দেশের অধিকাংশ এলাকায় এই শিলাস্তর ভূস্তরের অনেক গভীরে অবস্থিত; তবে উত্তরপশ্চিমাঞ্চলে তা কয়েক’শ মিটার থেকে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত গভীরে অবস্থিত। সবচেয়ে কম গভীরতায় (১২৮ মিটার) যে ভিত্তিশিলার স্তরটি রয়েছে, সেটি দিনাজপুরের মধ্যপাড়ায়। সেখানেই দেশের একমাত্র কঠিন শিলার ভূগর্ভস্থ খনি। সেই খনি থেকে ডায়োরাইট, টোনালাইট, গ্র্যানোডায়োরাইট ইত্যাদি কঠিন শিলা তোলা হচ্ছে। এগুলো প্রধানত রাস্তাঘাট, সেতু, ইমারত ইত্যাদির নির্মাণকাজে ব্যবহার করা হয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞান বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে ভিত্তিশিলা নিয়ে গবেষণা চলছে; গবেষণার ফলাফল বিভিন্ন দেশিবিদেশি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। চলমান গবেষণার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি রংপুরের বড় পাহাড়পুর অঞ্চলের ভিত্তিশিলায় খনন কূপ জিডিএইচ ৫৪তে (GDH ৫৪) অল্প পরিমাণ সোনার উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩৬৫ মিটার গভীরে অবস্থিত এই ভিত্তিশিলা মূলত ডায়োরাইট। এটাকে ৪৭৮ ও ৪৮৫ মিটার গভীরতায় দুটি হর্নবলেনডাইট শিলা ছেদন করেছে, যাকে ভূতাত্ত্বিক পরিভাষায় বলা হয় হর্নবলেনডাইট ডাইক (dyke)। এই দুটি ডাইকের শিলাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এবং কোর লগিং (Core logging) পর্যবেক্ষণে ধাতব খনিজের উপস্থিতির প্রমাণ মিলেছে।

মধ্যপাড়ায় ভূগর্ভস্থ খনি থেকে যে কঠিন শিলা আহরণ করা হচ্ছে, তাও শিলাতাত্ত্বিক বিবেচনায় জিডিএইচ ৫৪ খনন কূপে আবিষ্কৃত সোনার আকরিকের আধার শিলার (host rock) অনুরূপ। মধ্যপাড়া খনিতে পরিত্যক্ত খনন কূপগুলোর দেয়ালের বিভিন্ন শিলার ভূতাত্ত্বিক মানচিত্র (ভধপব সধঢ়ঢ়রহম), কাঠামোগত অধ্যয়ন ও নমুনা শিলার প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণ কার্যক্রম হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। -লেখকঃ অধ্যাপক,  জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং কঠিন শিলা ও খনিজবিষয়ক গবেষক