মৃদুভাষী কিন্তু দৃঢ়চেতা মানুষ ছিলেন

প্রকাশের সময় : 2019-02-14 15:39:12 | প্রকাশক : Admin মৃদুভাষী কিন্তু দৃঢ়চেতা মানুষ ছিলেন

বিভুরঞ্জন সরকার: শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে কোন পরিচয়ে পাঠকদের সামনে তুলে ধরলে সেটা যথার্থ হবে বুঝতে পারছি না। কর্ম জীবন কাটিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে, কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করে। কখনো দেশে, কখনো বিদেশে। ঝানু কূটনীতিক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্বও পালন করেছেন। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে যোগ দিলেন রাজনীতিতে। রাজনীতিতে সাফল্যও পেয়েছেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর ক্ষমতায় এলে কিবরিয়া সাহেব মন্ত্রী হলেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তিনি বেশ দক্ষতার সাথেই সামলেছেন। তিনি সংসদ সদস্য ছিলেন না। মন্ত্রী হয়েছিলেন টেকনোক্রাট হিসেবে।

২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি হবিগঞ্জ সদর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন না পাওয়ায় সরকার গঠন করতে পারলো না। ক্ষমতায় এলো বিএনপি-জামায়াত জোট। তখন কিবরিয়া সাহেব একটি সাপ্তাহিক কাগজ বের করলেন। নাম ‘মৃদুভাষণ’। অনেকেই বলেছিলেন, দেশে চলছে চন্ড শাসন। এখন মৃদুভাষণ কেন, এখন লাগবে কড়া ভাষণ। মৃদুভাষণে কাজ হবে না। কিন্তু কিবরিয়া সাহেব নিজে সজ্জন এবং মৃদুভাষী। তার শিক্ষা- রুচি- সংস্কৃতির সঙ্গে মৃদুভাষণই জুতসই। আমার মৃদুভাষণে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে, প্রায় চার বছর তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে  কাজ করার সুযোগ হয়েছে।

শাহ আবু মোহাম্মদ শামসুল কিবরিয়া ছিলেন একজন সুশৃঙ্খল মানুষ। সব কিছু গোছানো এবং পরিকল্পিত। রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর তার জীবনযাত্রায় কিছুটা পরিবর্তন এলেও তা কোনোভাবেই এলোমেলো ছিল না। সে সময় রাজনৈতিক সহকর্মীদের মধ্যে বেশি সময় কাটলেও তিনি তার পুরনো অভ্যাস খুব বদলাননি। সৃজনশীলতার প্রতি তার আকর্ষণ বরাবরের। লন্ডনপ্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরীর লেখার তিনি ছিলেন মুগ্ধ পাঠক। গাফফার চৌধুরীর লেখার জাদুকরী প্রভাবের কথা আমাদের বলতেন। দুজনের সম্পর্ক ছিল চমৎকার। ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের লেখারও ভক্ত ছিলেন কিবরিয়া সাহেব। মুনতাসীর মামুনের লেখায় শব্দচয়নে যে একটি হুল ফোটানোর প্রবণতা তা উপভোগ করতেন। তবে তিনি  নিজে কখনো আক্রমণাত্মক লেখা লিখতেন না। তিনি যেমন ছিলেন মৃদুভাষী, তেমনি লেখার ক্ষেত্রে শব্দ বাছাইয়েও ছিলেন সংযমী ও যুক্তিবাদী।

পরচর্চা পছন্দ করতেন না। কারো সম্পর্কে তার কোনো রিজার্ভেশন থাকলে তার সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতেন না, চুপচাপ থাকতেন। কারো সম্পর্কে কটূক্তি করতেন না, রূঢ় আচরণও করতেন না কারো সঙ্গে। সঙ্গত কারণেই তার সঙ্গে কেউ দুর্বিনীত আচরণ করলে তিনি দুঃখ পেতেন।

তার অপরিচিত, তরুণ কোনো সাংবাদিক বা লেখকের কোনো প্রতিবেদন বা লেখা পড়ে যদি তার ভালো লাগতো তাহলে তার তারিফ করতেন। মৃদুভাষণে তাকে দিয়ে লেখানো যায় কি না সে ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে বলতেন।

রাজনীতির দুইজন মানুষ সম্পর্কে কিবরিয়া সাহেবের মনোভাব তুলে ধরে লেখাটি শেষ করবো। রাষ্ট্রপতি পদ থেকে বিতাড়িত হয়ে ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিকল্প ধারা নামে নতুন দল করায় অনেকের মধ্যে যথেষ্ট আগ্রহ তৈরি হলেও কিবরিয়া সাহেব তার ব্যাপারে খুব উৎসাহ দেখাননি। আমাকে বলেছিলেন, ডাঃ বদরুদ্দোজাকে নিয়ে বেশি আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই। তিনি কোনো দৃঢ়চেতা মানুষ নন। তার মধ্যে সুবিধাবাদিতা আছে।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ডঃ কামাল হোসেনের প্রতি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা বোধ থাকলেও তার রাজনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে একমত হতে পারতেন না কিবরিয়া সাহেব।

প্রসঙ্গত তাজউদ্দিন আহমদের কথা উল্লেখ করে কিবরিয়া সাহেব বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে তিনি পারতেন নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে। তাজউদ্দিন সাহেব সে সময় আলাদা রাজনৈতিক দল গঠন করলে আওয়ামী লীগের জন্য তা হতো বড় চ্যালেঞ্জ। বঙ্গবন্ধুর সরকারকে দুর্বল করা যে প্রকারান্তরে বাংলাদেশকেই দুর্বল করা, বাংলাদেশ বিরোধীদের উৎসাহিত করা এটা তাজউদ্দিন সাহেব জানতেন এবং বুঝতেন। অথচ আওয়ামী লীগের তৈরি হয়েও কামাল হোসেন আওয়ামী লীগবিরোধীদের খুশি করেছেন।

সাম্প্রদায়িক অপশক্তি গ্রেনেড হামলা করে ২০০৫ সালের ২৫ জানুয়ারি তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে হত্যার পর এক যুগেরও বেশি সময় কেটে গেছে। দেশের জন্য যিনি ছিলেন নিবেদিত তাকে হত্যা করে যে শূন্যতা তৈরি করা হয়েছে তা সহজে পূরণ হবে না।