বিভুরঞ্জন সরকার: ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন কেমন হবে তা নিয়ে এখন জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই । কেউ বলছেন, শতভাগ স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচন কোনো দেশেই হয় না। বাংলাদেশেও হবে না। তবে একটি ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা করা হবে। আবার কেউ বলছেন, বাংলাদেশে এর আগে যে নির্বাচনগুলো হয়েছে, তার চেয়ে এবার আরো ভালো নির্বাচন হবে। ‘এর আগে’ বলতে ঠিক কোন সময়টাকে বোঝানো হয়েছে? স্বাধীনতা পরবর্তী পুরো সময়, নাকি পঁচাত্তর পরবর্তী পুরো সময় অথবা একানব্বই পরবর্তী সব নির্বাচন?
বিভিন্ন সময়ের অভিজ্ঞতা ভিন্ন ভিন্ন। তার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে দুই সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং এইচ এম এরশাদের আমলে। জিয়া গণভোট বা ‘হ্যাঁ, না’ ভোটের মধ্য দিয়ে যে নির্বাচনী তঞ্চকতা শুরু করেছিলেন তা তার সময়ে অনুষ্ঠিত সংসদ ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও অব্যাহত ছিলো। ওই সব নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছাপূরণের যন্ত্র ছিলো নির্বাচন কমিশন। জিয়ার ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটেছে ভোটের বাক্সে, জনমতের প্রতিফলন হয়নি। বিশেষ মেকানিজম ভোটে জয়-পরাজয় নির্ধারণে নিয়ামক ভূমিকা রেখেছে।
এরশাদ ক্ষমতা দখল করেও জিয়ার ভোট জালিয়াতির অপরাজনীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। ভোট ডাকাতি, ফলাফল উল্টো দেওয়াসহ নানা নির্বাচনী অনিয়ম তখন অবাধে চলেছে। অবস্থার পরিবর্তন ঘটে এরশাদ পতনের পর। যদিও পরাজিত পক্ষ একানব্বই-পরবর্তী নির্বাচনগুলো নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে, তবু সাধারণভাবে নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো দেশে-বিদেশে ভালো নির্বাচনের দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
দলীয় সরকারের অধীন সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না, তাই নির্বাচন হতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে, এই দাবি জনপ্রিয় করে তা মানতে বিএনপি সরকারকে বাধ্য করেছিলো আওয়ামী লীগ। কিন্তু ২০০১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিজ্ঞতার পর আওয়ামী লীগ এই ধরনের অনির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ধারণা থেকে সরে আসে। আওয়ামী লীগ এরপর ক্ষমতায় এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। বিএনপি তাতে অখুশি হয়। আগে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছিলো, আওয়ামী লীগ ছিলো পক্ষে। পরে অবস্থান বদলে যায়। বিএনপি চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার, আওয়ামী লীগ চায় না।
এই বিরোধের নিষ্পত্তি না হওয়ায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। পরিস্থিতির গুণগত কোনো পরিবর্তন না হলেও বিএনপি এবার অর্থাৎ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি এবং তার অনুসারী ও সমর্থকরাও নির্বাচনে যাচ্ছে। বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু বা ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয় বলে অব্যাহত প্রচার চালিয়েও বিএনপিপক্ষ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে কেন?
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, ‘এবার নির্বাচনের সার্থকতার ওপর ভবিষ্যতে দলীয় সরকার বহাল রেখে নির্বাচন হবে কিনা তা নির্ভর করবে’। অর্থাৎ একটি ভালো নির্বাচন যদি অনুষ্ঠিত হয় তাহলে বিএনপির এতো দিনের দাবি দুর্বল হয়ে পড়বে। আর মন্দ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ চাপে পড়বে। নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকারের পক্ষে তখন জনমত এবং আন্দোলন গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হবে।