আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী: সম্ভবত ১৯৭৩ সালের কথা। সন্ধ্যার দিকে বঙ্গবন্ধু পুরনো গণভবনের দোতলায় বিরাট কনফারেন্স রুমটাতে বসে আছেন। আমি সেখানে গিয়ে দেখি, তিনি ঘরোয়া বৈঠকে ব্যস্ত। সেখানে শেখ ফজলুল হক মনি, বদরুন্নেসা আহমদ, কাদের সিদ্দিকীসহ আরও অনেকে আছেন।
বঙ্গবন্ধু বললেন, দেশে দুর্নীতিবাজরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে। আমার চারদিকেও চাটার দল এসে জুটেছে। এদের আমি শক্ত হাতে দমন করতে চাই। দুর্ভাগ্যের কথা কি জান, এই দুর্নীতি বেশি করছে শিক্ষিত এবং ভদ্রলোকেরাই। আমি এদের সম্পর্কে একটা কবিতা লিখেছি। তোমরা শুনবে? বলেই তিনি তার পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে পড়তে শুরু করলেন। কয়েক লাইন শুনেই বুঝলাম, রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত 'বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে' কবিতাটির প্যারোডি এই কবিতা। তবে ভাষা ও ছন্দের গরমিল আছে। এখানে ভাষা ও ছন্দটাই বড় কথা নয়, বড় কথা, বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য।
কবিতার প্রথম দুটি লাইন হলো- 'আমার বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে/বাংলার ভদ্রলোকেরা শুধু চুরি করে, পোটলা বাঁধে।' বেশ দীর্ঘ কবিতা, বঙ্গবন্ধু পাঠ শেষ করলে অনেকেই জিজ্ঞেস করলেন, 'কবিতাটি আপনি কী করবেন?' বঙ্গবন্ধু বললেন, 'তোমাদের কাছেই রেখে যাব। আমার মৃত্যুর পর মানুষ জানবে, এ দেশের একশ্রেণির শিক্ষিত ভদ্রলোকের চুরি, দুর্নীতির ঠেলায় আমি পর্যন্ত বেসামাল হয়ে পড়েছিলাম।'
অনেকেই 'কবিতাটা আমাকে দিন' বলে বঙ্গবন্ধুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে বদরুন্নেসা আহমদ, শেখ মনি, এমনকি কাদের সিদ্দিকীও ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাদের দিকে চেয়ে বললেন, 'না, এটা তোমাদের দেব না। গাফ্ফারকে দেব। সে এটাকে কাজে লাগাতে পারবে। আমার মৃত্যুর পর নিন্দুকেরা অসত্য প্রচার চালালে গাফ্ফার উপযুক্ত জবাব দেবে।' এরপরই তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণ সম্পর্কে কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে ছিল একগাদা ফটোগ্রাফ। কাদেরিয়া বাহিনীর অস্ত্র সমর্পণের ছবি, কাদের সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুর সামনে নতজানু হয়ে অস্ত্র রাখছেন, তার ছবিও ছিল। বঙ্গবন্ধু খুশি হয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন।
বঙ্গবন্ধুকে বলা হয় লৌহকঠিন হৃদয়ের অধিকারী মানুষ। কিন্তু তিনি যে কতটা স্নেহ-কোমল হৃদয়ের অধিকারী মানুষ ছিলেন, তার প্রমাণ বহুবার পেয়েছি। ১৯৫৩-৫৪ সাল। তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক নির্বাচনের জোর প্রস্তুতি চলছে। প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী তখন নূরুল আমীন। তার সরকারের অত্যাচারে সাধারণ মানুষ জর্জরিত। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতা করার জন্য হক-ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছে। নূরুল আমীনকেও পরাজিত করা তখন যুক্তফ্রন্টের লক্ষ্য।
ঠিক হলো, নূরুল আমীনের নির্বাচনী কেন্দ্র নান্দাইলে হক, ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দী এই তিন নেতাই পরপর নির্বাচনী প্রচারে যাবেন এবং যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী ছাত্রনেতা খালেক নওয়াজ খানকে সমর্থন দেবেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাবশিষ্য তখনকার যুবনেতা শেখ মুজিব বললেন, তিনি কিছু ছাত্র ভলান্টিয়ার নিয়ে সোহরাওয়ার্দীর গাড়ির অনুগামী হবেন। এই ভলান্টিয়ারদের মধ্যে আমাকেও তিনি যুক্ত করলেন। আমি তখন ঢাকা কলেজের ছাত্র; কিন্তু ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত নই। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নান্দাইল যাত্রায় কোনো বিঘ্ন ঘটেনি। তাকে থাকতে দেওয়া হলো যুক্তফ্রন্টের এক স্থানীয় নেতার বাসায়। ছাত্র ভলান্টিয়ারদের সঙ্গে আমাদের আশ্রয় একটি ডাকবাংলোর মতো বাড়িতে। সম্ভবত ডাকবাংলোটা এখন সঠিকভাবে মনে নেই। শেখ মুজিবের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে; কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, আমাদের সঙ্গে থাকবেন।
লম্বা টানা হলের মতো কক্ষ। তাতে চার-পাঁচজনের থাকার মতো চার-পাঁচটি চৌঁকি পাতা। তার ওপর বিছানা। মুজিব ভাই আমাদের সঙ্গে একই রুমে। খাওয়া-দাওয়ার শেষে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ার পর বুঝলাম, নান্দাইলের মশা কত হিংস্র। কিন্তু কোনো বিছানাতেই মশারি নেই। কেবল মুজিব ভাইকে (তখন আমরা কেউ তাকে লিডার, কেউ কেউ মুজিব ভাই সম্বোধন করতাম) একটা কাঁথা দেওয়া হয়েছে; যেটা গায়ে চাপালে মশা আক্রমণ করতে পারবে না।
রাতে ঘুমানোর কোনো সুযোগ ছিল না। তবু মশা তাড়াচ্ছি, মশা মারছি- এই অবস্থায় চোখে তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে উঠতেই দেখি, আমার গায়ে একটি কাঁথা। মুজিব ভাই অদূরেই শুয়ে আছেন। তার গায়ে কাঁথা নেই। অর্থাৎ তার গায়ের কাঁথাটি তিনি আমার শরীরে চাপিয়ে দিয়ে গেছেন। আমি তন্দ্রার ঘোরে টের পাইনি। আমি কাঁথাটি তাকে ফিরিয়ে দিতে গেলে তিনি বাধা দিলেন। বললেন, 'ওটা গায়ে দিয়ে ঘুমাও। ভোর হতে বেশি দেরি নেই। আমার জন্য ভেবো না। বাংলার মশা আমাকে কামড়াবে না।' আজ সুদীর্ঘকাল পর বিদেশে বসে সেই রাতের কথা স্মরণ করছি আর ভাবছি, যে মানুষটি বলেছিলেন, বাংলার মশা আমাকে কামড়াবে না, সেই মানুষটিকে বাংলার একদল মানুষরূপী পশুই স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।