সময় গেলে সাধন হবে না!!

প্রকাশের সময় : 2020-01-29 14:37:28 | প্রকাশক : Administration সময় গেলে সাধন হবে না!!

ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীনঃ শিরোনামটি অতীব জনপ্রিয় গানের খুবই বিখ্যাত একটি কলি। গানটি গুনগুন করে গায়ও কেউ কেউ। তবে সবাই না গাইলেও কমবেশী জানে না এমন কেউ নেই। আর এটাও জানে যে কলিটি লালন শাহে্র কোন এক প্রখ্যাত গানের। মরমী সাধক লালন শাহ্ যেভাবে খুব সংক্ষেপে একটি বড় বিষয়কে গুছিয়ে সহজে বলতে পেরেছেন, এত সহজে আর কেউ পারেননি। কত চমৎকার সুরের চমৎকার কথা; দিন থাকিতে দিনের সাধন, কেন করলে না! সময় গেলে সাধন হবে না!!

মাঝে মাঝে আমার শোনিমও গায় গানটা। আনমনেই গায়। আনমনে শোনিম আরো দু’চারটি গানও গায়। মন্দ গায় না। ওর ছোট্ট গলার মিষ্টি কণ্ঠে বড় ভাল লাগে সেসব শুনতে। তবে খুব যে গান গায় তা নয়। মাঝেমধ্যে গুনগুন করে গায়। খেয়ালী গাওয়া যাকে বলে। আমরা অনুরোধ করলে, কিংবা শতবার বললেও গায় না। না তো না-ই। মুখে কলুপ আটে। গাইগুই করে। আবার না বললেও নিজ থেকেই মাঝেমধ্যে গেয়ে ওঠে। আড়ালে থেকে আমি শুনি। গানটি আমাকে টানেও বেশ। সুরের চেয়েও কথাগুলো আমাকে বেশী টানে। জীবনের জন্যে খুবই প্রয়োজনীয় কথা।

প্রায় একই রকম কথা বলতেন আমার জাপানী প্রফেসর সুসুমো ইয়ামাশিরো। কঠিন পন্ডিততুল্য অত্যন্ত উঁচু লেবেলের গবেষক এই মানুষটি সময়কে খুবই মূল্যায়ন করতেন। তবে লালন শাহে্র মত করে বলতেন না। বলতেন তাঁর মত করে। বলতেন, জীবনে অতীত আর ভবিষ্যত বলতে কিছু থাকলেও খুব বেশী মূল্য নেই সে সবের। মূল্য কেবলই বর্তমানের। যা কিছু করার এই বর্তমানেই করতে হবে। এখন করতে হবে। একটু পর কী হবে কেউ জানে না। আজকের কাজ কালকের জন্যে ফেলে রাখা যাবে না। কাল বৃষ্টি হতে পারে, তুষারও ঝরতে পারে।

আসলেই সময়ের কাজ সময়েই করতে হয়। অসময়ে করলে ফলাফল ঘরে তোলা যায় না। শীতের কনকনে ঠান্ডায় দূর জানালায় তুষার ঝরতে দেখে প্রফেসর ইয়ামাশিরোর কথাগুলো খুব মনে পড়ছিল। চারদিক তুষারে ধবল মেঘের মত সাদা হয়ে আছে। তারপরও ঝরছে। অঝোর ধারায় ঝরছে। থামাথামির নামগন্ধও নেই। হিমাঙ্কের অনেক নীচে তাপমাত্রা। ঘরে বসে বোঝার উপায় নেই। ২৪ ঘণ্টা হিটারে চলা ঘরে বসে বাইরের ঠান্ডা বোঝার কথাও না । অনেকটা বাংলাদেশের আভ্যন্তরীন বিষয়গুলোর মত। রাজনীতির বাইরে থেকে কিংবা ক্ষমতার ত্রিসীমানার মধ্যে না থেকে কোনভাবেই বোঝার উপায় নেই দেশে আসলে কী হচ্ছে। দেশের গেল কয়েক মাসের পরিস্থিতি দেখে আমার মত সাধারণ আমজনতা সত্যি সত্যি কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। কেবল এটুকু বোঝে যে ঘটনা ঘটছে একের পর এক। ঘটেই যাচ্ছে। হয় ঘটছে, না হয় ঘটানো হচ্ছে। এবং বিশ্লেষণ হচ্ছে নানাবিধ। যে যার মত বিশ্লেষণ করছেন।

কিন্তু এসব নিয়ে সদা সতর্ক থেকে অতন্ত্র প্রহরীর মত সবকিছু আগলে রেখে মন্ত্রণালয় তথা দেশকে রক্ষা করার জন্যে মন্ত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী যাদের নিয়োগ দিয়েছেন, তাদেরকে খুব বেশী দায়িত্ববান মনে হয়নি। সব ঘটনায় না হলেও, কোন কোন ঘটনায় দেশের কোন কোন দায়িত্বশীলদের ভূমিকায় এসব প্রশ্ন জনমনে ঘুরপাক খায়। খাবার কথাও। এড়িয়ে যাবার উপায় নেই; টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যর্থতার কথা উঠেছে। কথা যে বিরোধী পক্ষ থেকে উঠেছে, তা নয়। সাধারণ মানুষ, এমনকি খোদ আওয়ামী লীগ থেকেও তারা বিদ্ধ হচ্ছেন। 

মাঝেমাঝে সরকারকে চাপের মুখে পড়ার পেছনে এই ব্যর্থ মন্ত্রীদের ভাবলেশহীন ভূমিকা মোটেই এড়িয়ে যাবার মত নয়; উড়িয়ে দেবার মতও নয়। গত ১১ বছরের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকার এরকম চাপের মুখে আগে কখনোই পড়েনি। তাদের ব্যর্থতার কারণেই পরিস্থিতি মাঝেমধ্যেই নাগালের বাইরে চলে যায়। এবং মন্ত্রীরা দায়িত্ব পালনে কতটুকু যোগ্য, সেই প্রশ্নও উঠে। বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীদের নিয়ে এসব প্রশ্ন চায়ের টেবিলে অনেকবার ঝড় উঠিয়েছে।

সবচেয়ে বেশী আলোচনা হয়েছে বানিজ্যমন্ত্রীকে নিয়ে। তোফায়েল আহমেদের জায়গায় কেন যেন তিনি মানানসই হতে পারেননি। একটানা তিনমাস ধরেই পেঁয়াজের বাজারে আগুন জ্বলেছে এবং লাগামহীন উর্ধ্বগতিতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। সরকার পড়েছিল তীব্র সমালোচনার মুখে। খুব বেশী না ভেবেই বলা যায়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এই পেঁয়াজ সংকট মোকাবেলায় যথাযথ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। সংকটের প্রথম থেকেই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। জনগণ মনে করেছে সংকট মোকাবেলায় বাণিজ্যমন্ত্রী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছেন। এমনকি দুঃখজনক হলো, সংকট চলাকালীন তিনি অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ কাজে অস্ট্রেলিয়াও ভ্রমণ করেছেন।

অন্যদিকে পেঁয়াজের পরে চালের বাজারও অস্থির হয়ে উঠেছিল। শুধু তাই নয়। বাড়তে শুরু করে আটার দামও। এমনিতেই বিভিন্নভাবে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে সমস্যায় পড়তে হয়েছে দেশবাসীর। তার ওপর আটার দাম বৃদ্ধি আরো একটি সমস্যা সৃষ্টি করেছিল। সত্যি বলতে এভাবেই চলেছে দেশ। এভাবেই চলেছে অরাজগতা। যে যার যার ইচ্ছামতো জনগণ নিয়ে খেলেছে ।

আটা, চালের বাজার অস্থির হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যমন্ত্রীকে নিয়েও অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। তাঁর একের পর এক বক্তৃতা, বিবৃতি জনমনে বিরক্তির উদ্রেক করেছে। মনে করা হয়েছিল, পেঁয়াজের পর যদি চাল আটার দাম লাগামহীন হয়ে যায়, তাহলে মানুষের অস্বস্তি অসন্তোষের পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। কিন্তু কপাল ভাল। ওসব হয়নি। এর আগেই সতর্ক হয়েছে সরকার।

এদিকে মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রীর কথা না বললেই নয়। স্বাধীনতা উত্তর বিজয় দিবসে সরকার তথা রাষ্ট্রকে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে এতটা বিব্রতকর অবস্থায় এর আগে কখনো পড়তে হয়নি। তিনি রাজাকার তালিকা নিয়ে কঠিন ন্যাক্কারজনক ঘটনা বাঁধিয়ে ফেললেন। রাজাকারদের তালিকায় স্বীকৃত নামীদামী মুক্তিযোদ্ধাদের ঢুকিয়ে দিলেন। ঠ্যালায় পড়ে দুঃখপ্রকাশ কিংবা ক্ষমা চাইলেই কি এর জের শেষ হবে! দু’চার বছরেও শেষ হবে না। জাতিকে বহুকাল এর কলঙ্কের বোঝা বহন করতে হবে।

প্রশ্ন হলো, এমনি সব ব্যর্থ মন্ত্রীদের দায় কে নেবে? অবশ্য আওয়ামী লীগের তিন টার্মের মন্ত্রিসভার বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যখন কোন মন্ত্রী সমস্যায় পড়েন বা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন, তখনই তাকে সরিয়ে দেওয়া হয় না। বরং সেই মন্ত্রীকে সাহায্য সহযোগীতা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন প্রধানমন্ত্রী নিজে। সেই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে এই মন্ত্রীরা থাকবেন নাকি পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য তাদের সরিয়ে দেওয়া হবে, সেটাই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন।

প্রশ্ন এই কারণে যে, তারা মন্ত্রী হিসেবে বছর পার করেছেন। কিন্তু বেশ কিছু সফল মন্ত্রীর মত এখনও জ্বলে উঠতে পারেননি। মনে হয় না, তাঁদের জ্বলে ওঠার সম্ভাবনা আদৌ আছে। তবে তাঁরা যে একেবারে জ্বলছেন না তাও নয়। চাঁদের আলোর মত প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব আলোতে নিভু নিভু হয়ে জ্বলছেন বটে। কিন্তু এভাবে তো চলে না। সরকার যখন মনে করছে, তাঁর বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এবং সেটাকে সম্মিলিতভাবে মোকাবেলা করতে হবে; তখন তো এসব মান্যবর মন্ত্রীদের নিজের আলোয় অনেক বেশী জ্বলজ্বল করে জ্বলা দরকার। সক্ষম হওয়া দরকার।

তাঁরা ততটা সক্ষম হতে পারবেন বলে আপাতত মনে করার কোন কারণ নেই। সক্ষমতা দেখানোর জন্যে এক বছর মোটেই কম সময় নয়। তাঁরা যথেষ্ট সময় পেয়েছেন এবং কর্মদক্ষতা দেখানোর মত বেশ কয়েকটা ক্রাইসিস পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। তবে নিজস্ব দক্ষতায় পারেননি ওসবে উত্তীর্ণ হতে। পারেননি শক্ত হাতে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে প্রধানমন্ত্রী তথা জনগণকে নিশ্চিন্তে রাখতে। যদি পারতেন তাহলে কোন ঘটনাই শেষতক আতঙ্কের দিকে যেত না।

দেশ সত্যিসত্যি আতঙ্কগ্রস্ত হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়া খুবই কঠিন হয়ে যায়। জনগণ মুখ ঘুরিয়ে নেয় সরকারের দিক থেকে। বিপদে পড়ে সরকার। আপদে পড়ে মানুষ। মানুষ ভাবতে শুরু করে। পরপর বেশ কয়েকটি ঘটনার পর মানুষ আসলেই ভাবতে শুরু করেছে। চায়ের টেবিলের আড্ডায় কিংবা হাটেমাঠেঘাটের আলোচনায় আপাত ব্যর্থ মন্ত্রীদের নিয়ে তুমুল কথা হচ্ছে। পক্ষেবিপক্ষে দু’দিকেই হচ্ছে। বলা হচ্ছে সময় থাকতে এখনই ব্যবস্থা নেয়া দরকার। না হলে হয়ত লালন শাহে্র কথাই সত্যি হবে। সময় গেলে সাধন হবে না!!!