নিঃস্বার্থ ভালোবাসা

আজকে প্রায় বিশ বছর পর আমার সঙ্গে হৃদির দেখা হবে। আমাদের ডিপার্টমেন্টের রি-ইউনিয়ন। এই ধরনের প্রোগ্রামে আমার খুব একটা অংশগ্রহণ করা হয়না। তবুও হৃদি আসবে শুনেই আমি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

হৃদি, আমি এবং টুটুল একই ডিপার্টমেন্টের ছিলাম। আমরা তিনজন বন্ধু ছিলাম। আমি এবং টুটুল দুইজনই হৃদির প্রেমে অন্ধ ছিলাম। টুটুল বুঝতো, আমিও বুঝতাম। কিন্তু প্রেম হয়ে গেলো হৃদি এবং টুটুলের মধ্যে। সেই প্রথম আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলার কষ্ট কি তীব্র হতে পারে।

আমাদের বন্ধুত্ব ভেঙ্গে যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু টুটুল নামক পাগল ছেলেটার জন্য ভাঙেনি। অদ্ভুত একটা ছেলে এই টুটুল। আমাকে এবং হৃদিকে প্রায় গল্প করার সুযোগ ও ইচ্ছে করে দিতো। যেখানে যাবে আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। এমন হয়েছে আমরা মুভি দেখতে গিয়েছি। হৃদি মাঝখানে। দুইপাশে আমি এবং টুটুল। এসব ঘটনায় হৃদির সঙ্গে আমার সম্পর্ক বন্ধুত্বের বাইরে একটুও এগোয়নি বরং টুটুলের প্রতি আমার হিংসে পানি হয়ে গিয়েছিলো। ওর প্রতি আমি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা অনুভব করতাম।

ওদের দুজনের বিয়ে হলো। সেই বিয়ের সাক্ষীও আমি। যেই মেয়েকে একসময় খুব ভালবাসতাম সেই মেয়ের বিয়ের সাক্ষী আমি। ততদিনে আমি প্রেম, সংসারের জটিলতা বুঝতে শিখেছি। প্রেম ব্যাপারটা দূর থেকেই সুন্দর। কত মান, অভিমান, রাগ, ঝগড়া এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। তখন মাঝে মধ্যেই আমার মনে হতো যে হৃদির সঙ্গে আমার প্রেম না হয়ে ভালোই হয়েছে। ওর মতো সুন্দরীর পেছনে ছেলেদের এত লাইন, এত আগ্রহ আমার পক্ষে সহ্য করা কষ্ট হতো। অন্যদিকে টুটুল হচ্ছে প্রাণোচ্ছল একটা ছেলে। খুবই মেধাবী, অলরাউন্ডার একজন।

তার মানবিক গুণাবলী ছিলো দারুণ। সবাইকে নিয়ে থাকতে খুব পছন্দ করতো। ওর বিয়ের পর আমাদের যোগাযোগ কমতে থাকলো। আমার পোস্টিং হলো ঢাকার বাইরে। আর ওর ঢাকায়। আমি প্রায় বলতাম আয় বন্ধু সিলেটে ঘুরে যা। ও বলতো এই আসছি বলে।

আবার সেই পুরানো দিনের মতো দুজন গল্পে, আড্ডায় মেতে উঠবো।

ওর ছেলে প্রান্ত হলো। ও সেই উত্তেজিত। আমাকে ফোন করে বলছে

বন্ধু বাবা হওয়ার পর সবসময় একটা জিনিস মনে হচ্ছে ছেলেটা বড় হওয়া পর্যন্ত যেন বেঁচে থাকি। আমার আঙ্গুল ধরে ওকে যেন হাটতে শিখাতে পারি, দৌঁড়াতে শিখাতে পারি, মাথা উঁচু করে উড়তে শিখাতে পারি। ওকে জড়িয়ে ধরলে মনে হয় এই পৃথিবীতে কষ্ট বলে কিছু নেই। ওকে জড়িয়ে ধরলে মনে হয় অফিস পলিটিক্স, দেশের সমস্যা, সামাজিক সমস্যা, পারিবারিক সমস্যা কোন সমস্যাই সমস্যা না। শুধু মনে হয় পৃথিবীটা এত সুন্দর কেন। চারপাশে এত রং কেন?

প্রান্ত বড় হতে থাকলো। কিন্তু টুটুলের সিলেট আসা হচ্ছিলো না। আমি ঢাকায় গেলেও ওর সঙ্গে দেখা করার সময় হয়ে উঠতো না।

টুটুল হঠাৎ ভীষণ অসুস্থ হয়ে গেলো। আমার বিয়ের অনুষ্ঠানে আসতে পারলো না। আমি বন্ধুর জন্য ঢাকায় ছুটে এলাম। হাসপাতালের সাদা বিছানাতেও ওকে আমার প্রাণোচ্ছল লাগছিলো। আমার দিকে তাকিয়ে বললো শুধু তোর সঙ্গে দেখা করার জন্য অসুস্থ হয়ে পরে আছি। জানি এমনিতে আসবি না। একমাত্র অসুস্থ হলেই আসবি। তাই অসুস্থ হলাম।

আমি ওর হাত ধরে বসে আছি। ও যে কত গল্প করছে।

বন্ধু জানি না প্রান্তর বড় হওয়া আমার দেখা হবে কিনা? আমি যদি চলে যাই ওদের খেয়াল রাখিস। দেখ বন্ধু ভালোবাসা একটা অনুভূতি ছাড়া আর কিছু না। সময়ের সঙ্গে ভালোবাসা ফুরিয়ে যায়। নানা প্রয়োজন এসে বাসা বাঁধে। আমি যদি চলে যাই খুব স্বাভাবিক যে হৃদিকে বিয়ে করতে হবে। ওর মত ভালো মেয়ের একা একা জীবন কাটিয়ে দেয়ার কোন মানে হয়না।

দেখ তারপরেও আমার হৃদয়ের গভীরে বড় ইচ্ছে আচ্ছা হৃদি যদি শুধু আমাকে ভালোবেসে এক জীবন কাটিয়ে দিতে পারতো তাহলে কি দারুণ না হতো। আমি ওই আকাশ থেকে তাকিয়ে দেখতাম আর চোখের জল ফেলতাম। কিন্তু এতটা স্বার্থপর হওয়ার কোন মানে হয়না। সঙ্গী ছাড়া একজীবন কাটানোর কোন মানে নেই। শুধু প্রার্থনা করি যেই আসুক হৃদির জীবনে সে যেন আমার প্রান্তকে আমার চাইতে বেশি ভালোবাসে। ওর মতো ভালো ছেলে হয়না। জানিস ও এই ছোট বয়সে আমার জন্য স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করে

আমার বাবাকে সুস্থ করে দাও।

আমি বললাম কিসব উল্টাপাল্টা কথা বলছিস। তোর কিছুই হয়নি। তুই সুস্থ হয়ে যাবি।

টুটুল আমার হাতে একটা চিঠি দিলো।

দোস্ত আমার একটা কথা রাখিস। যেদিন হৃদির আবার বিয়ে হবে। ও আবার নতুন করে সংসার শুরু করবে। এই চিঠি ওকে দিস। ও যেন কোন অপরাধ-বোধে না ভোগে তার জন্য আমি একটা চিঠি লিখেছি। ওকে দিস।

টুটুল ঠিক তার পরেরদিন ভোর সাতটা দশে মারা যায়।

আমি কিছুদিন হৃদির খবর রাখার খুব চেষ্টা করি। কেন জানি আমার বউ জিনিসটা তেমন ভালো চোখে দেখছিলো না। অন্যদিকে হৃদিও কেমন জানি একা থাকতে চাচ্ছিলো। এভাবেই আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ড হয়ে গেলো। আজ এত বছর পর আমার সঙ্গে হৃদির দেখা হবে। আমি শুনেছিলাম ওর বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছিলো। বিয়েও হয়েছে হয়তো। আজকে বিশ বছর পর আমি টুটুলের সেই পুরাতন চিঠিটা পকেটে করে নিয়ে এসেছি হৃদিকে দেয়ার জন্য।

রি-ইউনিয়নের স্পট থেকে একটু দূরে একটা লেকের ধারে আমি এবং হৃদি। আমি আজও হৃদিকে দেখে মুগ্ধ হচ্ছি। বয়স হয়েছে কিন্তু চেহারায় সেই ব্যক্তিত্ব। কত প্রশ্ন আমার বুকে। তাই হৃদিকে বলে লেকের পাড়ে নিয়ে এসেছি। পকেটে টুটুলের সেই মলিন চিঠিটা খসখস করছে।

বিয়ে করেছিস?

হৃদি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। শুন তুই আমাকে জিজ্ঞেস করলি না আমি বিয়ে করেছি কিনা। এই প্রশ্নের উত্তর এখানে। টুটুল ছিলো সেই স্বামী। কিভাবে মনকে শান্ত করতে হয়, কিভাবে জীবনকে সহজ করতে হয়, কিভাবে ক্ষুদ্র জিনিসে আনন্দ পেতে হয়; সেই সব প্রশ্নের উত্তর ছিলো ওর কাছে। আমার এবং প্রান্তর জীবন কিভাবে নিরাপদ হবে, কিভাবে আনন্দময় হবে, আমাদের যেন ভবিষ্যতে চিন্তা করতে না হয় তার সবকিছুর সমাধান ছিলো টুটুলের কাছে।

ও জীবনের শেষ প্রান্তেও এসে নিশ্চিত করে গিয়েছে আমাদের যেন ভবিষ্যতে হাত পাততে না হয়। ভালোভাবে না চললেও আমাদের জীবনের চলা যেন কখনো থামতে না হয়। আমাকে লড়তে শিখিয়েছে ও। জানিস আমার জীবনে যে ছেলে আসেনি এমন নয়। কেউ বন্ধু হয়েছে। কেউ বা প্রেম নিবেদন করেছে। কেউ বিয়ে করতে চেয়েছে। আমি যে বন্ধুত্ব করিনি, ঘুরে বেড়াইনি তাও না। কিন্তু একটা কথা কি জানিস টুটুলের জায়গাটা আমি আর কাউকে দিতে পারিনি। পারিনি সেই জায়গায় আর কাউকে বসাতে। টুটুল আমার জীবনে একজনই এসেছিলো।

আমি মুগ্ধ হয়ে হৃদিকে দেখছি।

জানিস আমাদের ছেলে প্রান্ত অনেক বড় হয়েছে। আমেরিকায় পড়াশুনা করছে। আমাকে প্রতিদিন ফোন করে। বলে-

মা তুমি চলে আসো।

জানিস ওর ছোটবেলার গল্প মনেও নেই। কিন্তু শুধু আমার কাছে ও ওর বাবার গল্প শুনে বলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা আমার বাবা। টুটুলের দুইটা জিনিস আমরা সবসময় ব্যবহার করি। প্রান্ত ওর বাবার ঘড়ি। আর আমি ওর বাবার সানগ−াস। কতজন আমাকে বলে এটা ছেলেদের। আমি বলি ছেলেদের হউক এটা আমার আত্মার অবিচ্ছেদ্য অংশ।

তুই আলাদা কেন হৃদি? আমি একটুও আলাদা নারে। আমার জীবনেও ভালোলাগা এসেছে, সময় কাটিয়েছি, হয়তো প্রেমেও পরেছি কিন্তু টুটুলের জায়গাটা কাউকে আর দিতে পারিনি।

হৃদি হেঁটে চলে যাচ্ছে। ওকে আমার টুটুলের চিঠিটা দেয়া হয়নি।

আমি টুটুলের চিঠিটা খুলি। সেখানে লেখা-

প্রিয় টুনি,

যখন তুমি এই চিঠিটা পড়বে তার অর্থ হচ্ছে তুমি নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছো। প্রান্ত পেতে যাচ্ছে তার নতুন বাবা। তুমি কিন্তু একটুও গিলটি ফিলিংস করো না। আমাদের জীবনটা এমন। আমাদের গল্পটা ততটুকুই লিখা ছিলো যতটুকু স্রষ্টা ঠিক করে রেখেছে। আমি তোমার এই সিদ্ধান্তে ভীষণ খুশি। প্রিয় মানুষকে আনন্দে দেখার চাইতে খুশি আর কিছু হতে পারে না। নিজের যত্ন নিতে একদম ভুলো না। প্রান্তকে দেখে রেখো। আমি চেয়েছিলাম আমার ছেলে আমার হাত ধরে বড় হবে। সেই দায়িত্ব তোমার। ও তোমার হাত ধরে বড় হবে। এবং আমি তোমাকে চিনি আমি জানি তুমি সেই হাত কখনো ছাড়বে না।

তোমার নতুন গল্প, নতুন জীবন আনন্দের হউক।

ইতি তোমার টুনা।

আমি চিঠিটা লেকের পানিতে ছুড়ে মারি এবং বিড়বিড় করে বলি-

টুটুল তোর গল্প শেষ হয়নি। শেষ হবেও না। তোর গল্প চলবে। তুই এক অদ্ভুত মানুষ ছিলি এবং অদ্ভুত ভালবাসায় সবাইকে জড়িয়ে রেখেছিস। এই অদ্ভুত ভালোবাসার গল্প চলতেই থাকবে। - সংগৃহিত

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com