দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া

প্রকাশের সময় : 2018-06-27 19:50:54 | প্রকাশক : Admin
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া

সিমেক ডেস্কঃ একদিন হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া মুরিদদের জন্য বিশেষ ‘সামা’ মাহফিলের আয়োজন করেন। কিন্তু রান্নাবান্নার আয়োজন দেখেই হাজারখানি লোক জড়ো হয়ে গেলো সেখানে। মাহফিলের জন্য ৫০-৬০ জনের রান্নার ব্যবস্থা হচ্ছিল। হঠাৎ করে এতো লোক দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সঙ্গীরা। তবে নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দরগাহ থেকে কেউ খালি মুখে ফেরত যাবে না এমনটা অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

হযরত নিজামউদ্দিন তার এক খাদেমকে ডেকে উপস্থিত সকলের হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করতে বললেন। দশজন দশজন করে খাবারের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিলেন তিনি। খাদেমরা একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকাতে তিনি খাদ্যসংকট সমাধানের একটি উপায় বাতলে দিলেন। প্রতিটি রুটি চারভাগ করে একেক ভাগ একজনকে দিতে বললেন নিজামউদ্দিন। তবে রুটি দেয়ার আগে ‘বিসমিল্লাহ শরীফ’ অবশ্যই পড়ে নিতে হবে। খাদেমরা সেই নির্দেশ মোতাবেক দোয়া পড়ে সবাইকে চারভাগের একভাগ করে রুটি দিতে লাগলেন। মহান আল্লাহ্ অশেষ রহমতে উপস্থিত হাজারো ব্যক্তি তৃপ্তির সাথে খানা শেষ করলেন। বিস্ময়ের সাথে খাদেমরা আবিষ্কার করলেন অতিথিরা খেয়ে দরগাহ থেকে চলে যাওয়ার পরও রুটি অবশিষ্ট ছিল।

এমনই হাজারো সব চমকপ্রদ ঘটনার সাথে মিশে আছে একটি নাম- নিজামউদ্দিন আউলিয়া। ভারতীয় উপমহাদেশে যে ক’জন সুফি সাধক এসে এই অঞ্চলের মানুষের মাঝে সুফি মতবাদকে জনপ্রিয় করে গেছেন, তাদের মধ্যে মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন আউলিয়া অন্যতম পথিকৃৎ। তাকে অনেক সময় হযরত নিজামউদ্দিন বলেও ডাকা হয়। এই অঞ্চলে চিশতিয়া তরিকার একজন নামকরা সুফি সাধক তিনি। তার পূর্বসূরি ছিলেন ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকার, কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী এবং মইনউদ্দিন চিশতী। পূর্বসূরিদের পথ ধরে প্রেম বা ইশককে সৃষ্টিকর্তাকে পাওয়ার পথ হিসেবেই বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে খোদার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে ভালোবাসলেই ঈশ্বর সবচেয়ে বেশি খুশি হন। ধর্মীয় বহুত্ববাদ এবং সকলের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধে ভীষণ বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। ১৪ শতকের এক ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারানির ভাষ্যমতে, নিজামউদ্দিন আউলিয়া তৎকালীন মুসলিমদের উপরে এতোটাই প্রভাব বিস্তার করেছিলেন যে তারা দুনিয়াবী চিন্তা বাদ দিয়ে ইবাদতের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। পার্থিব বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে পারার মতো ব্যক্তিত্বের জাদু নিয়ে দিল্ল−ীতে সুফিবাদকে জনপ্রিয় করেন এই আউলিয়া।

খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়া হিজরি ৬৩৬ সনে জন্মগ্রহণ করেন বলে জানা যায়, ইংরেজি সন অনুযায়ী সেটা ১২৩৯ সাল। ধর্মের প্রতি তাঁর ভক্তি ও শ্রদ্ধার জন্য তিনি ‘মেহবুব-এ-এলাহি’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। গিয়াসউদ্দিন বলবানের আমলে তাকে ‘শামস-উল-মালিক’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল মোহাম্মদ। বংশগত দিক থেকে তিনি হযরত আলী (রাঃ) এর উত্তরসূরি। হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর মৃত্যুর বেশ কিছুকাল পরে বুখারা থেকে লাহোরে চলে আসে তাঁর পরিবার। সেখান থেকে নিজামউদ্দিনের দাদা ও তাঁর ভাই, খাজা আলী এবং খাজা আরব সপরিবারে ভারতের উত্তর প্রদেশের বাদায়ুনে চলে আসেন। সেখানেই সফরের ২৭ তারিখে জন্ম হয় নাজিমউদ্দিনের। মাত্র ৫ বছর বয়সে বাবা সৈয়দ আবদুল্লাহ বিন আহমেদ আল হুসাইনি বাদায়ুনিকে হারান তিনি। মা বিবি জুলেখার দেখাশোনাতেই বেড়ে ওঠেন নিজামউদ্দিন, মায়ের হাত ধরে চলে আসেন দিল্লীতে। নিজামউদ্দিন আউলিয়ার জীবনী প্রথম উল্লে−খ করা হয় ‘আইন-ই-আকবরি’ নামক একটি প্রবন্ধে। ষোড়শ শতকে এই প্রবন্ধটি লেখেন মোঘল বাদশা আকবরের উজির, আবুল-ই-ফজল ইবন মুবারাক।

বিশ বছর বয়সে নিজামউদ্দিন অযোধ্যায় চলে আসেন এবং সুফি সাধক ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকারের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকার মূলত বাবা ফরিদ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। নিজামউদ্দিন অযোধ্যায় তাঁর স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেননি। দিল্লীতে   ধর্মতত্ত্ব শিক্ষার পাশাপাশি সুফিবাদের প্রতিও তাঁর পড়াশোনা শুরু হয়ে যায়। প্রতি বছর বাবা ফরিদের উপস্থিতিতে অযোধ্যায় পবিত্র রমজান মাসব্যাপী ইবাদত-বন্দেগী করতেন তিনি। অযোধ্যায় তৃতীয় রমজান মাস অতিবাহিত করতে এলে বাবা ফরিদ তাকে নিজের উত্তরাধিকারী বা খলিফা হিসেবে মনোনীত করেন। এ ঘটনার পরপরই দিল্লীতে এসে তিনি খবর পান যে বাবা ফরিদ মারা গেছেন।

গিয়াসপুরে পাকাপোক্তভাবে বসবাস শুরু করার আগে দিল্লীর বিভিন্ন জায়গায় ছিলেন নিজামউদ্দিন। শহরের কোলাহল থেকে কিছুটা দূরে একটি ফাঁকা জায়গা খুঁজে বের করেন তিনি। এখানেই তিনি তাঁর খানকাহ নির্মাণ করেন। খানকাহ হলো এমন একটি জায়গা যেখানে সর্বস্তরের জনগণকে খাওয়ানো হয়, তাদের সেবা করা হয় এবং আধ্যাত্মিক বিষয়াদি সম্পর্কে জানানো হয়। খানকাহের পাশেই নিজের থাকার জায়গার ব্যবস্থা করেন নিজামউদ্দিন। খুব শীঘ্রই তাঁর এই খানকাহটি ধনী-গরিব সব ধরনের মানুষের ভিড়ে জনারণ্যে পরিণত হয়। নিজামউদ্দিনের নম্রতা ও ধর্মভীরুতা সাধারণ মানুষের মন ছুঁয়ে যায়। দূরদূরান্ত থেকে তাকে এক ঝলক দেখতে আসে ভক্তরা। সে সময়কার দিল্লীর সুলতানও তাঁর অনেক প্রশংসা করেন। চারটি বই লেখেন নিজামউদ্দিন।

তাঁর বহু শিষ্য আধ্যাত্মিকতায় উচ্চাসন অর্জন করেন যাদের মধ্যে রয়েছেন শেখ নাসিরউদ্দিন চিরাগ এবং আমির খসরু, যিনি দিল্লী রাজসভার কবি এবং প্রখ্যাত গায়ক ছিলেন। মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে শুরুর ঐ গল্পটির মতো আরও অনেক গাঁথা যার অধিকাংশই সত্য বলে প্রমাণিত। জানা যায়, একবার হযরত মাওলানা ওয়াজিহুদ্দিন, হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার এক মুরিদ, যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হন। চিকিৎসকরা যখন তার জীবন নিয়ে আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন তখন তার বন্ধুরা তাকে পরামর্শ দেয় নিজামউদ্দিনের খানকাহে কয়েকদিন থেকে আসতে। শহর থেকে দূরে নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশে তিনি ভালো থাকবেন বলেই মনে করেন তার বন্ধুরা।

বন্ধুদের কথামতো ওয়াজিহুদ্দিন সন্ধ্যায় ইফতারের সময়ে খানকাহে গিয়ে পৌঁছান। খানকাহের এক মুরিদ হযরত নিজামউদ্দিনের জন্য মেথির লাড্ডু নিয়ে আসেন। এই সুফিসাধক তাকে নিজের সাথে বসে ইফতার করার আহ্বান জানান। সবার সাথে ওয়াজিহুদ্দিনও বসে যান ইফতার করতে। ইফতারের এক পর্যায়ে এসে তিনি সুস্বাদু ঐ মেথির লাড্ডু মুখে দিয়ে অভিভূত হয়ে পড়েন।

এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে ঔষধি গুণে মেথি খুব নামকরা হলেও তার মতো শরীর গরমকারী বস্তু খুব কমই আছে। বিশেষত যক্ষ্মারোগীদের জন্য তা রীতিমতো আত্মঘাতী হিসেবে কাজ করে। কিন্তু মহান আল্লাহ্ তায়ালার কৃপায় লাড্ডুর অন্যান্য ঔষধি গুণের প্রভাবে খুব দ্রুত আরোগ্য লাভ করেন মাওলানা সাহেব এবং জীবনে আর কখনো তাকে এই রোগ ভোগাতে পারেনি। নিজামউদ্দিনকে যারা আল্লাহ্ অলি হিসেবে মানতে নারাজ ছিলেন, তারাও এই বিস্ময়কর ঘটনা দেখে নিজেদের কথা ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হন।

১৩২৫ খ্রিস্টাব্দের ৩ এপ্রিল সকালে ইহলোক ত্যাগ করেন মহান এই সুফি সাধক। তার খানকাহ, নিজামউদ্দিন দরগাহ, দিল্লীতে অবস্থিত। সব ধরনের বিশ্বাস নিয়েই লোকে এই দরগাহে আসে। খাস দিলে খোদার দরবারে দোয়া করা দিল্লীর এই মহাপুরুষ গানে, সংস্কৃতিতে, কবিতায়, মানুষের মুখে আর ভক্তদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন সহস্রকাল।

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com