হারানো শৈশব; কুড়ানো সেই সব!! (৩৩ তম পর্ব)

প্রকাশের সময় : 2018-06-27 18:43:24 | প্রকাশক : Admin
�হারানো শৈশব; কুড়ানো সেই সব!! (৩৩ তম পর্ব)

ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীনঃ এই হলো আমার ছেলেবেলার স্মৃতিতে থাকা আমাদের আখতার স্যার। স্যারকে ছেলেবেলার ঐ বয়সে কিছুটা চেনার সুযোগ থাকলেও ব্যক্তি আখতার হোসেন মন্ডলকে ভাল করে চেনাজানার সুযোগ কিংবা ক্ষমতা তখন ছিল না। থাকার কথাও না। তখন বয়সই বা কত। ঐ বয়সে একটি মানুষকে আর কতটুকুই বা চেনা যায়! সব সময় থাকতাম তাঁর রাগী চেহারা আর ধমকের ভয়তে। চেষ্টাই থাকতো সকল সময় কিভাবে কতটা দূরে থাকা যায়। হয়ত এ কারণেই ভাল করে চিনতে পারিনি।

এখনও এই বয়সেও যে ভাল করে চিনি সেটাও নয়। এখন চেষ্টা নেই দূরে থাকার, কিন্তু জীবনের বাস্তবতা এমনিতেই দূরে রাখে। আর দীর্ঘদিনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা স্যারকে ভাল করে জানার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে। এবং সেই সুযোগ কোনকালে আর পাবো বলেও মনে হয় না। তবে শান্তনার কথা হলো, ডিজিটাল যুগের সুবাদে স্যারের সাথে আবারো পূনঃযোগাযোগ হয়েছে এবং মাঝেমধ্যে কথাও হয়। আমিও ফোন করি, তিনিও করেন। তবে আমি যত না করি, স্যার করেন তার চেয়ে বেশী। 

গেল মে মাসের প্রথম দিকের কোন এক সকালে স্যারের ফোন। দূর্ভাগ্যবশত ফোনটা ধরতে পারিনি। বিকেলে শিবলীর কাছ থেকে জানলাম স্যার ওকেও ফোন দিয়েছিলেন। ৭১ টেলিভিশন স্যারের লাইভ ইন্টারভিউ করবে। টিভির লোকজন ইতিমধ্যেই স্যারের বাসায় চলে এসেছে। বাসা থেকেই লাইভ প্রোগ্রাম হবে। স্যারও প্রস্তুত হচ্ছেন। তড়িঘড়ি করে স্যার অনেককেই ফোন দিয়ে বিষয়টি জানাচ্ছেন। আমাকে সেই জন্যই ফোন দিয়েছিলেন।

ফোনটা ধরতে না পারলেও তৎক্ষনাৎ ইউটিউবে দীর্ঘ সময় নিয়ে করা পুরো ইন্টারভিউটা একশ্বাসে দেখে নিলোম। মন্ত্রমুগ্ধের মতই দেখলাম। কী সাবলীল এবং চমৎকার প্রাণোচ্ছোল ভাষা এবং অভিব্যক্তিতে স্যার মনের সব কথা গুছিয়ে বলে গেলেন। কোথাও থামাথামি নেই, ক্যামেরা কাট নেই; জড়তা নেই। নেই কথাবার্তায় আগের মত শুদ্ধতার কোন কমতি।

এই শুদ্ধতা নিয়ে কত যে ধমক খেয়েছি স্যারের। স্যার সারাক্ষণই তটস্ত রাখতেন সব সময় যেন শুদ্ধ ভাষায় কথা বলি। কী বাংলা, কী ইংরেজী; উচ্চারণে কোন ত্র“টি চলবে না। গফরগাঁয়ের প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ। অথচ কথা শুনে ধরার কায়দা নেই, স্যারের বাড়ী কোথায়। নিজেই কঠিন   প্র্যাকটিস করতেন, আমাদেরকেও রাখতেন প্র্যাকটিসে। কোন ছাড় নেই।

ক্লাশ সেভেন এর ইংরেজী ক্লাস। স্যার দ্রুতপঠন পড়াচ্ছেন। চ্যাপ্টারের নাম Key to Paradise। স্যার একজন একজন করে ধরছেন; বল্, চাবি ইংরেজী কি? পিছন থেকে একজন একজন করে বলেই চলেছে, জানা জিনিস; চাবি ইংরেজী তো কি (Key)। হচ্ছে না। কারোটাই হচ্ছে না। ভাবলাম মজা করছেন স্যার; গুগলি দিচ্ছেন। একজন বললো, সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলে বলবো আমি কি? তবুও হচ্ছে না। এবার আমার পালা। গুগলির তালের চোটে মারাত্মক ভুল করে ফেললাম। স্যারকে যা কোনভাবেই বলা যায় না, তাই বলে ফেললাম। পটাপট দাঁড়িয়ে বললাম,......মত প্রশ্ন করলে উত্তর দিবো কি?

আর যাই কোথায়। সেদিন দেখেছিলাম স্যারের রাগ। চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে খপ করে আমাকে ঘাড় ধরে ন্যুইয়ে দিলেন। এরপর হাতের ডাস্টার দিয়ে আঘাত। একের পর এক আঘাত। ঘাড় আর পিঠে শালশা আঘাত। রাগে গজগজ হয়ে স্যার কাঁপছেন; মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। অস্পষ্ট উচ্চারণ। কেবল একটি শব্দই বুঝতে পারছিলাম। বেয়াদ্দপ, বেয়াদ্দপ! ডাস্টারের জোড়ের কাছে বেয়াদ্দপ শব্দটি তেমন জোড় পাচ্ছিল না।

এক সময় রণে ভংগ দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে স্যার চেয়ারে ফিরলেন। এবং হঠাৎ করে একদমই দমে গেলেন। কোন কথা নেই ভীষণ রাগী মানুষটির মুখে। আমি মাথা নীচু করে কাঁদছি। টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে আমার দুচোখ বেয়ে। স্যার সেদিকে তাকাতেই চান না। কিছুক্ষণ চুপ হয়ে বসে থাকলেন। এবং এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছুটা স্থির হয়ে বললেন, চাবি ইংরেজী হলো ‘কী...’। কী শব্দটায় একটু লম্বা টান হবে। কি এবং কী এর মাঝের উচ্চারণগত পার্থক্যটা চমৎকার ভাবে বুঝিয়ে বললেন।

এমনি করে এই মানুষটি ভাল আর মন্দের পার্থক্যও সব সময় দেখিয়ে দিতেন। বলতেন, তোদের মত বয়সী যে ছেলেরা স্কুলে ফুলহাতা জামার হাতা বটে রাখে কিংবা বুকের বোতাম খুলে হাঁটে এরা কখনো ভাল মানুষ হতে পারে না। কোন না কোন গলদ আছে এদের মধ্যে। কোনভাবেই কোন শর্তেই স্যার কোন ছাত্রকে তাঁর সামনে এটা করতে দিতেন না। খুব রাগ করতেন। ছেলেবেলার দেখা সেই রাগী মানুষটাকে টিভি প্রোগ্রামে দেখে চেনাই যায় না। চেহারার গড়নে বদল হয়েছে, তবে কথার ধরণে নয়। জ্ঞানে এবং বিদ্যায় পরিপূর্ণ মানুষটির কথা এবং বাক্যচয়নে ছিল প্রচন্ড তীক্ষ্মতা। অনেক কথাই বলেছেন। একটানা বলে গেছেন। প্রোগ্রামটা না দেখলে জানাই হতো না অনেক কিছু। জানতেই পারতাম না, স্যার সম্মূখ সমরে হাতে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছেন। আজকের শুভ্র শুশ্রুমন্ডিত মুখাবয়ব দেখে সেটা বোঝার উপায় নেই।

লাইভ টিভি প্রোগ্রামে স্যারকে ফতুয়া গায়ে সাদা শুশ্রুমন্ডিত মুখাবয়বে বেশ মানানসই ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একজন মানুষ বলেই মনে হচ্ছিল। তবে অবাক হয়েছি তাঁর নতুন পরিচয়ে। আখতার স্যার বাংলাদেশ টেলিভিশনের একজন অডিশন প্রাপ্ত গীতিকার। প্রায় আড়াইশত গান ইতিমধ্যেই তিনি লিখেছেন যার অনেকগুলোই টিভিতে প্রচারও হয়েছে। নিজের লেখা ও সুর করা একটি গানও গেয়ে শুনিয়েছেন। চমৎকার গান। গেয়েছেনও মন্দ নয়। কন্ঠে বয়সের ছাপ এলেও তিনি উতরে গেছেন সাবলীল ভাবেই। পুরো গানটাই গেয়েছেন। সংস্কৃতিমনা মানুষটির গান শুনেছিলাম ছেলেবেলায়। খুব একটা গাইতেন না। কি একটা প্রোগ্রামে হারমোনিয়াম বাজিয়ে কন্ঠ মেলে ধরেছিলেন, লাইলী তোমার এসেছে ফিরিয়া, মজনু গো আঁখি খোল!

গান গেয়ে তিনি কোনদিন কারো চোখ খোলাতে পেরেছিলেন কিনা জানি না, তবে আজো তাঁর নিজের চোখ খুলে রেখেছেন দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি। বর্তমান এবং অতীতের প্রতি। অতীতকে ভুলেননি     বলেই তিনি গান লিখেছেন জীবনের প্রথম কর্মস্থল ধলা হাই স্কুলকে নিয়ে। প্রচন্ড ভালবাসা থেকেই তিনি লিখেছেন। তিনি একদিন এই স্কুলে শিক্ষকতা করতেন এটা তাঁর গর্বের অংশ বলে মনে হয়।

গর্ব করার হাজারো কারণও আছে। ব্রিটিশ আমলে অবিভক্ত সারা বাংলার একমাত্র শিক্ষাবোর্ড ছিল রাজধানী কোলকাতায়। আজকের সমস্ত বাংলাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এন্ট্রেন্স বা মেট্রিক পরীক্ষা হতো এ কোলকাতা বোর্ডের আওতায়। তখনও ঢাকা শিক্ষা বোর্ড হয়নি। প্রতিবছর ফলাফলে ধলা হাই স্কুল মেধা তালিকায় জায়গা পেত। সর্বোচ্চ মেধাবী বিশজনার মাঝে ধলা স্কুল কমবেশী চারপাঁচটা করে স্থান দখল করে নিত।

এমনই স্কুলকে নিয়ে স্যার তো গর্ব করেই গান লিখবেন। আর স্কুলটিও তো এখন আর শুধু স্কুল নেই। কয়েক বছর হলো আমরাই যথেষ্ট খাটাখাটুনী আর চেষ্টা তদবীর করে কলেজে উত্তীর্ণ করেছি। স্যারের খুব আশা, সুযোগ হলে একদিন কলেজটি দেখতে যাবেন। নিজের লেখা গান হয়ত নিজেই গেয়ে শোনাবেন। আমাকে তাঁর মনোভাবটা মোটামুটি বলেছেনও একাধিকবার।

শুনে চুপ থেকেছি। বলতে পারিনি কিছু। পারিনি আজও স্যারকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করতে। পারার সম্ভাবনাও নেই। না পারার হাজারটা না হোক, বেশ কিছু কারণ তো আছেই। স্যার যখন আমাদেরকে ঐতিহ্যবাহী এই স্কুলে পড়াতেন, স্কুলটির ঐতিহ্য তখন তেমন না থাকলেও একেবারে হারিয়ে যায়নি। কিন্তু আজিকার অবস্থা বড়ই করুন। ঐতিহ্যের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। আছে দৈন্যদশা। আখতার স্যারের জীবনের প্রথম কর্মস্থলের দৈন্যদশার চিত্র জানে না এমন কেউ নেই।

মনে হয় বাতাস লেগেছে স্কুলে। খুব অশুভ বাতাস। কবে থেকে লেগেছে এটা গবেষণার বিষয়। কিন্তু অশুভ সেই বাতাসের প্রভাবে এটি যে আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না, তা পরিস্কার। প্রতিযোগীতার এই যুগে কেউ পিছিয়ে নেই। কিছুদিন আগেও অস্তিত্ব ছিল না, আশপাশের এমন প্রতিষ্ঠানও তরতর করে এগিয়ে চলেছে। আর প্রাণপ্রিয় এই প্রতিষ্ঠানটি দিনকে দিন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে কেবলই পেছাচ্ছে। বলা যায় পঙ্গুত্ব গ্রাস করেছে। একদিন সদর্পে বুক ফুলিয়ে চলা প্রতিষ্ঠানটির আজকের এই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলাকে পঙ্গুত্বই তো বলে। নাকি বলে না!!! চলবে.....

 

সম্পাদক ও প্রকাশক: সরদার মোঃ শাহীন
উপদেষ্টা সম্পাদক: রফিকুল ইসলাম সুজন
বার্তা সম্পাদক: ফোয়ারা ইয়াছমিন
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: আবু মুসা
সহ: সম্পাদক: মোঃ শামছুজ্জামান

প্রকাশক কর্তৃক সিমেক ফাউন্ডেশন এর পক্ষে
বিএস প্রিন্টিং প্রেস, ৫২/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড,
ওয়ারী, ঢাকা থেকে মুদ্রিত ও ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা-১২৩০ হতে প্রকাশিত।

বানিজ্যিক অফিস: ৫৫, শোনিম টাওয়ার,
শাহ মখ্দুম এ্যাভিনিউ, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
বার্তা বিভাগ: বাড়ি # ৩৩, রোড # ১৫, সেক্টর # ১২, উত্তরা, ঢাকা।
ফোন: ০১৮৯৬০৫৭৯৯৯
Email: simecnews@gmail.com